শুক্রবার, ৪ অক্টোবর ২০২৪, ১৯ আশ্বিন ১৪৩১

সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে সমুদ্র অর্থনীতি

প্রকাশিতঃ ৭ জুলাই ২০২৪ | ১০:৪০ পূর্বাহ্ন


নজরুল কবির দীপু : সমুদ্র উপকূলীয় দেশ হওয়ায় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সমুদ্রের ভূমিকা অপরিসীম। সমুদ্র অর্থনীতি বা ব্লু-ইকোনমি বলতে সমুদ্রের সম্পদসমূহের টেকসই ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বোঝায়। বাংলাদেশের বিশাল সমুদ্রসীমা এবং সম্পদশালী উপকূলীয় অঞ্চল বিবেচনায় দেশের অর্থনীতিতে সমুদ্র অর্থনীতির সম্ভাবনা অপরিসীম।

বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় প্রচুর পরিমাণে মাছ ও অন্যান্য জলজ সম্পদ রয়েছে। এসব সম্পদের টেকসই আহরণ ও প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। এছাড়া বাংলাদেশের দক্ষ জনশক্তি এবং কম খরচের সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে জাহাজ নির্মাণ ও মেরামত শিল্পকে একটি সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।

শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের সুন্দর সমুদ্র সৈকত, দ্বীপ এবং উপকূলীয় অঞ্চলগুলোকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা সম্ভব। সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে বাংলাদেশের রপ্তানি-আমদানি বাণিজ্যকে আরও গতিশীল করা সম্ভব। সমুদ্র তলদেশে থাকা খনিজ সম্পদ যেমন তেল, গ্যাস, এবং অন্যান্য মূল্যবান ধাতুর অনুসন্ধান ও আহরণের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করা সম্ভব। উপকূলীয় অঞ্চলে বায়ু ও সৌর শক্তি উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের জ্বালানি চাহিদা মেটানো এবং পরিবেশ দূষণ কমানো সম্ভব।

তবে সমুদ্র অর্থনীতির কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যেমন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা উপকূলীয় অঞ্চলের অবকাঠামো এবং জীবিকার উপর মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে। শিল্প-কারখানার বর্জ্য, প্লাস্টিক দূষণ, তেল ছড়িয়ে পড়া ইত্যাদি কারণে সামুদ্রিক পরিবেশ দূষিত হচ্ছে, যা সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য এবং মৎস্য সম্পদের জন্য হুমকি স্বরূপ। সমুদ্র অর্থনীতির সম্ভাবনা পুরোপুরি কাজে লাগানোর জন্য পর্যাপ্ত বন্দর, জাহাজ নির্মাণ ও মেরামতের সুবিধা, এবং অন্যান্য অবকাঠামোর উন্নয়ন প্রয়োজন। সমুদ্র খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণের জন্য উন্নত প্রযুক্তি এবং দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন।

তবে, এই বিষয়ে সবাই একমত হবেন যে, সমুদ্র অর্থনীতি বাংলাদেশের জন্য একটি অপার সম্ভাবনাময় খাত। সঠিক পরিকল্পনা, বিনিয়োগ এবং টেকসই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই খাতকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চালিকা শক্তি হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। তবে এজন্য জলবায়ু পরিবর্তন, সামুদ্রিক দূষণ এবং অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা মোকাবেলা করে টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে হবে।

সমুদ্র অর্থনীতি নিয়ে বহু আলোচনা, সেমিনার হয়েছে; লেখালেখি হয়েছে পত্রপত্রিকায়। কিন্তু এখন পর্যন্ত সমুদ্র অর্থনীতির তেমন কোনো সুফল আমরা ঘরে তুলতে পারিনি। মূলত মৎস্য আহরণের মধ্যেই সমুদ্রসম্পদ আহরণের বিষয়টি সীমাবদ্ধ রয়েছে বলা যায়। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এ খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানসহ সব মহলের সমন্বিত অংশগ্রহণ প্রয়োজন। টেকসই অর্থনীতির জন্য টেকসই সমুদ্র ব্যবস্থাপনা জরুরি। শুধু মৎস্য আহরণ নয়; জ্বালানি, কৃষি, পণ্য পরিবহণ ও পর্যটনসহ সমুদ্রকেন্দ্রিক অন্যান্য সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সরকারকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। এ সংক্রান্ত পৃথক মন্ত্রণালয় বা বিভাগ গঠন করার প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে।

সুনীল অর্থনীতিসংক্রান্ত সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা পর্যালোচনায় দেখা যায়, এতে কৌশল হিসাবে বলা হয়েছে-সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে একটি সবল নীতিকাঠামো প্রয়োজন। এ কাজ সম্পাদনের জন্য স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হবে। এই নীতিকাঠামো অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিপরিষদে পেশ করা হবে। সুনীল অর্থনীতির উন্নয়নে বিনিয়োগের বেশিরভাগই আসতে হবে বেসরকারি খাত থেকে। নতুন জ্ঞান, প্রযুক্তি ও বিনিয়োগ আনার জন্য সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই’র ভূমিকা বিস্তৃত করা হবে ইত্যাদি।

আমরা জানি, সমুদ্র অর্থনীতির সম্ভাবনা কাজে লাগাতে ২০২০ সালে ১০ ধরনের কৌশল নির্ধারণ করেছিল সরকারের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)। তবে সেসব এখনো কেবল পরিকল্পনা ও কৌশলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। আমরা মনে করি, এগুলোর বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। তা না হলে আমাদের সমুদ্রসম্পদ অন্য দেশে চলে যেতে পারে। অনেক দেশের অর্থনীতিতে সমুদ্র নানাভাবে অবদান রেখে চলেছে। ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় অর্থনীতির সিংহভাগ সমুদ্রনির্ভর। অস্ট্রেলিয়া সমুদ্রসম্পদ থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ আয় করে থাকে। বাংলাদেশ জনবহুল রাষ্ট্র হওয়ায় সমুদ্রসম্পদ আহরণের প্রয়োজনীয়তা আমাদের আরও বেশি। অথচ এক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি। এ অবস্থার পরিবর্তন জরুরি। এক্ষেত্রে বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।