শুক্রবার, ৪ অক্টোবর ২০২৪, ১৯ আশ্বিন ১৪৩১

নতুন কারিকুলাম নিয়ে উদ্বেগ ও প্রত্যাশা

প্রকাশিতঃ ১৪ জুলাই ২০২৪ | ৭:২৪ পূর্বাহ্ন


নজরুল কবির দীপু : নতুন কারিকুলামের আওতায় গত ৩ জুলাই শিক্ষার্থীদের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা শুরুর পর থেকেই দেশজুড়ে বিতর্কের ঝড় বইছে। প্রশ্নফাঁস, পরীক্ষায় বই দেখে উত্তর দেওয়া, শিক্ষকদের ভূমিকা নিয়ে অভিযোগ উঠেছে। কোনো কোনো শিক্ষার্থীর গল্প-গুজব করে সময় নষ্ট করা, পড়াশোনা না করে গ্রুপ আলোচনা করে পরীক্ষা দেওয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে। এসব ঘটনায় শিক্ষার্থীদের মৌলিক চিন্তাশক্তি হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা করছেন অভিভাবকরা।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের উদাসীনতাকে প্রশ্নফাঁসের জন্য দায়ী করা হলেও কর্তৃপক্ষ মনে করছে, এতে শিক্ষার্থীদের তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। তারা শিক্ষার্থীদের দক্ষতা যাচাইয়ের জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলছে। তবে প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষকদের অনলাইন দক্ষতা ও প্রযুক্তিগত সুযোগ-সুবিধার অভাব প্রশ্নফাঁসের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

নতুন কারিকুলামের মূল লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীর দক্ষতা ও যোগ্যতা যাচাই করা। এনসিটিবির চেয়ারম্যানের মতে, নতুন পদ্ধতিতে শিক্ষার্থী কী শিখল, তার কার্যক্রমভিত্তিক মূল্যায়ন করা হচ্ছে। তার পারদর্শিতার মাধ্যমেই তার যোগ্যতা প্রকাশ পাবে।

তবে বাস্তবতা হলো, নতুন কারিকুলামের আওতায় নোট-গাইড ও কোচিং সেন্টারের প্রতি শিক্ষার্থীদের নির্ভরতা কমেনি। নতুন শিক্ষাক্রমের সব দিক এখনো সবার কাছে পরিষ্কার নয়। কর্তৃপক্ষের দোদুল্যমানতা নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।

এ অবস্থায়, নতুন শিক্ষাক্রমের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। প্রশ্নফাঁস রোধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের মৌলিক চিন্তাশক্তি বিকাশে নতুন পদ্ধতি প্রণয়ন করতে হবে।

আমাদের শিক্ষার্থীরা যেন অন্য দেশের শিক্ষার্থীদের তুলনায় পিছিয়ে না পড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাদেরকে আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যোগ্য করে গড়ে তোলাই হোক আমাদের মূল লক্ষ্য।

নতুন কারিকুলামের এই প্রাথমিক পর্যায়ে যেসব সমস্যা দেখা দিয়েছে, তা সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের নামে তাদের যেন অতিরিক্ত মানসিক চাপের মধ্যে ঠেলে না দেওয়া হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র যেন শিক্ষার্থীদের বয়স ও শ্রেণির উপযোগী হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে সহায়তা করতে হবে।

অভিভাবকদের উদ্বেগ দূর করতে সরকারের সঙ্গে তাদের খোলামেলা আলোচনার প্রয়োজন। শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নতুন কারিকুলামের সুফল পাওয়া সম্ভব। শিক্ষা ব্যবস্থার এই আমুল পরিবর্তনে সবার সহযোগিতা একান্ত কাম্য।

নতুন কারিকুলামের সফল বাস্তবায়ন শুধু সরকার বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একার দায়িত্ব নয়। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সচেতনতা ও সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও গতিশীল ও সময়োপযোগী করে গড়ে তোলা সম্ভব।

আবার বলি, নতুন কারিকুলামের সফল বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষকদের ভূমিকা অপরিহার্য। তাদেরকে নতুন শিক্ষা পদ্ধতি, মূল্যায়ন প্রক্রিয়া এবং প্রযুক্তির ব্যবহার সম্পর্কে সঠিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে। শিক্ষকদের মধ্যে নতুন কারিকুলাম সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করতে হবে। তারা যেন নিজেরাই এই পরিবর্তনের অংশীদার হতে পারেন, সেই পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

শিক্ষার্থীদের মধ্যেও নতুন কারিকুলামের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা জরুরি। তাদেরকে বোঝাতে হবে, এই পরিবর্তন তাদের সার্বিক বিকাশের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্বাধীন চিন্তা, সৃজনশীলতা এবং সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার জন্য নতুন কারিকুলামের যথাযথ বাস্তবায়ন জরুরি।

নতুন কারিকুলামের সাথে প্রযুক্তির সমন্বয় সাধন করতে হবে। শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। অনলাইন শিক্ষা, ভার্চুয়াল ক্লাসরুম, ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্মের মতো আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতির ব্যবহার বাড়াতে হবে।

পাঠ্যপুস্তকের মান উন্নয়ন করতে হবে। পাঠ্যপুস্তক যেন শুধু তথ্যের ভান্ডার না হয়ে শিক্ষার্থীদের চিন্তাশক্তি ও সৃজনশীলতা বিকাশে সহায়ক হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে। পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সহায়ক শিক্ষা উপকরণ, যেমন- রেফারেন্স বই, ম্যাগাজিন, অনলাইন রিসোর্স ইত্যাদির সুযোগ করে দিতে হবে।

সর্বোপরি, নতুন কারিকুলামের মূল লক্ষ্য যেন শিক্ষার্থীদের সার্বিক বিকাশ, সেদিকে সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের যেন শুধু পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার জন্য নয়, বরং জীবনের সকল ক্ষেত্রে সফল হওয়ার জন্য প্রস্তুত করা হয়, সেই লক্ষ্যে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।