শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩০ ভাদ্র ১৪৩১

হে আল্লাহ, আজাদ তালুকদারকে জান্নাতের মেহমান বানাও

একুশে পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আজাদ তালুকদারের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০২৩ সালের ২ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তাঁর স্মরণে এই লেখা।

প্রকাশিতঃ ২ অগাস্ট ২০২৪ | ৯:৫০ অপরাহ্ন


শামছুল ইসলাম হাকেমী : প্রতিটি নতুন দিনের সূচনায়, কঠিন বাস্তবতার আড়ালে লুকিয়ে থাকে অপার সম্ভাবনার দিগন্ত, যেখানে আমাদের পদচিহ্ন অঙ্কিত হয়। জীবন যেন এক মায়াবী সেতু, যা আমাদের হৃদয়কে স্পন্দিত করে, মনকে উজ্জীবিত করে, আর কর্মে উদ্যম জোগায়। এই যাত্রাপথের অন্তিম প্রান্তে ‘মৃত্যু’ নামক পরম সত্য অপেক্ষা করে। কিন্তু মৃত্যুর পরেই যেন এই সেতুবন্ধন আরও দৃঢ় হয়, যেন জীবনের সুর আরও স্পষ্ট হয়।

এই পৃথিবীতে, অল্প কিছু কৃতি মানুষ তাঁদের জীবদ্দশায় সাফল্যের স্বীকৃতি পেয়ে গেছেন। তেমনি এক উজ্জ্বল নক্ষত্র একুশে পত্রিকার প্রয়াত সম্পাদক আজাদ তালুকদার। তিনি কেবল একজন সাংবাদিক নন, তিনি সাংবাদিকতার আদর্শ, এক অনন্য কিংবদন্তি। তাঁর হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হয় সাংবাদিকতার সুর, তাঁর প্রতিটি শব্দে ফুটে ওঠে সত্যের সন্ধান।

অতি অল্প সময়েই, তিনি নিষ্ঠা, আন্তরিকতা, পরিশ্রম, প্রজ্ঞা, দক্ষতা, সততা, সাহসিকতা এবং দেশপ্রেমের এক অভূতপূর্ব সমন্বয়ে নিজেকে এক অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তাঁর সাংবাদিকতা ছিল নির্ভীক, বস্তুনিষ্ঠ, এবং অকুতোভয়। এই অসাধারণ গুণাবলীর সমাহারে, তিনি একজন সফল, সার্থক, এবং আদর্শ সাংবাদিক ও সম্পাদক হিসেবে সর্বত্র সমাদৃত হয়েছিলেন।

বিশেষ করে, একুশে পত্রিকায় আমার স্নেহধন্য সন্তান শরীফুল রুকনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন এবং সাহসী সংবাদগুলি তাঁকে এবং একুশে পত্রিকাকে এক অনন্য মর্যাদায় উন্নীত করেছে। তাঁর নেতৃত্বে একঝাঁক সংবাদকর্মী আত্মপ্রত্যয়ী, আত্মসংযমী, আত্মত্যাগী, এবং আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর অনুপ্রেরণা ও তেজোদীপ্ত মহিমা তাঁদেরকে অকুতোভয় করে তুলেছিল, যেন তারা আলোর পথিক হয়ে সত্যের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছিল।

আজাদ তালুকদার, একজন সাংবাদিক যিনি হৃদয় দিয়ে লিখতেন, জীবন দিয়ে সংবাদ করতেন। তিনি ছিলেন সবার প্রিয়, সবার আপন। রাষ্ট্রের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, সবার হৃদয়ে তিনি রাজত্ব করেছেন। তাঁর মোহনীয় ব্যক্তিত্ব, সৃজনশীল মনন, আর হৃদয়স্পর্শী লেখনী সবাইকে মুগ্ধ করেছে। তাঁর কর্মযজ্ঞ, তাঁর একুশে পত্রিকা, সময়ের আবর্তে ইতিহাসের এক অমূল্য অধ্যায় হয়ে থাকবে।

কিন্তু হায়! মৃত্যু কারও জন্য অপেক্ষা করে না। আজাদ তালুকদারের অকাল প্রয়াণ আমাদের হৃদয় ভেঙে দিয়েছে। দেশ ও জাতির এমন এক নির্ভীক, নিবেদিতপ্রাণ সাংবাদিকের প্রয়োজন ছিল আরও অনেক দিন। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছাই সব! তাঁর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

‘এমন জীবন করিও গঠন, মরণে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভূবন’- এই কথাগুলো যেন আজাদ তালুকদারের জীবনের প্রতিচ্ছবি। গত বছর ২ আগস্ট, চট্টগ্রাম ওয়াসা মোড়ে জমিয়তুল ফালাহ মসজিদ প্রাঙ্গণে জোহরের নামাজের পর তাঁর জানাজায় সমবেত হয়েছিল সর্বস্তরের মানুষ। চোখের জল আর বুকের ব্যথা নিয়ে সবাই যেন এক সুরে বিলাপ করছিল, ‘আমাদের ছেড়ে চলে গেলে কেন আজাদ ভাই?’

জামাল খান সড়কে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে, তাঁর সহযোদ্ধা সাংবাদিক ভাইয়েরা স্মৃতির পাতা উল্টে তাঁর কর্মময় জীবনের কথা বলছিলেন। কিন্তু চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু লুকোনো যায়নি। প্রেসক্লাবে দ্বিতীয় জানাজায় আমি নিজেই ইমামতি করেছিলাম। মনে হচ্ছিল যেন নিজের পরিবারের একজনকে হারিয়েছি। আজাদ ভাই, আপনি ছিলেন আমাদের আত্মার আত্মীয়, আমাদের আপনজন।

আজাদ ভাইয়ের সাথে আমার নিয়মিত যোগাযোগ হতো। ফোনে কথা বলতেন, পরামর্শ নিতেন, এমনকি শরিয়তের মাসয়ালা নিয়েও আলোচনা করতেন। আমাকেও আজাদ ভাই মন থেকে ভালোবাসতেন। সবসময় ‘চাচা’ বলে সম্বোধন করে দোয়া চাইতেন। তাঁর মনে পবিত্র হজ করার একটা তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল। কিন্তু ক্যান্সারের নির্মম থাবা তাঁকে সেই সুযোগ দিল না। অবশেষে না ফেরার দেশে চলে গেলেন আমার আপনজন, আমার আজাদ ভাই।

আল্লাহর অশেষ মেহেরবানী! তাঁতে ওমরাহ হজের ভিসা পাওয়ায় ব্যবস্থা করে দিতে পেরেছিলাম। এই কাজটি করতে পেরে আমার বুকটা ভরে উঠেছিল! চিকিৎসা নিতে ভারত যাওয়ার পর সেখান থেকেই তিনি পাড়ি দিয়েছিলেন পবিত্র মক্কা ও মদিনার পথে। অসুস্থ অবস্থায়ও রাসূল (সা.) এর প্রিয় শহরে ওমরাহ পালন করার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর, যা আল্লাহর অশেষ রহমত!

হে আল্লাহ, তোমার দরবারে এই অধমের ফরিয়াদ, আজাদ তালুকদারের জন্য তোমার দয়া ও করুণা চাই। তাঁকে তোমার অসীম রহমতের আলোয় সিক্ত করে, তোমার জান্নাতের মেহমান বানিয়ে নাও।