হোসেন আবদুল মান্নান : গত বছর আগস্টের এই দিনে তিনি পরলোকে গমন করেন। মাসটি বাঙালিদের কাছে ইতোমধ্যেই শোকাবহ আগস্ট নামে পরিচিতি লাভ করেছে। বাঙালির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামসহ হাজারও কীর্তিমান এ মাসেই ইহলোক ছেড়ে চলে যান। আগস্টে আমার জন্মদায়িনী মা-ও পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। তাই আগস্ট সত্যিই আমাকে বিষন্ন এবং অশ্রুসিক্ত করে দেয়। বছর ঘুরে ঘুরে আমার হৃদয়ের শাখা ধরে সজোরে নাড়া দিয়ে যায়।
দুই.
আজাদ তালুকদার চট্টগ্রামের একজন প্রতিথযশা সাংবাদিক ছিলেন। ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট উভয় মাধ্যমেই তিনি কাজ করেছেন। মিডিয়ার অদৃশ্য জগত থেকে বহুবিধ অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি নিজেই ‘একুশে পত্রিকা’ নামে একটি সাপ্তাহিক প্রকাশ করেছিলেন। পত্রিকাটি বন্দরনগরী চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক হলেও গুণগত মান ও বিষয়-বৈচিত্র্যের কারণে এটি রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছিল।
আজাদ তালুকদার হয়ে ওঠেছিলেন এর মধ্যমণি ও হৃৎস্পন্দনের মতন। পত্রিকাটি ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান, তাঁর প্রাণ-বায়ুর ন্যায়। বলা বাহুল্য, তাঁর প্রয়াণের একবছর পরেও একুশে পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। যার নেপথ্যে রয়েছে তাঁর নিজের হাতে গড়ে তোলা কতিপয় মেধাবী, পরিশ্রমী ও চৌকস কুশীলব। মূলত তারাই প্রতিকুল স্রোতে ভাসমান এক ছোট্ট তরীর হাল ধরে আছেন শক্ত হাতে।
তিন.
চট্টগ্রামের হাতেগোনা একেবারে মুষ্টিমেয় সজ্জনের মধ্যে আজাদের কথা আমার মনে পড়ে যায়। চট্টগ্রাম বরাবরই আমার কাছে এক মোহময় নস্টালজিক জনপদ। এ যেনো আমার আপন ছায়ার জীবন্ত প্রতিবিম্ব হয়ে সারাক্ষণ দেহের সঙ্গে লেগে থাকে। চট্টগ্রাম আমার স্মৃতির আয়নায় দুলতে থাকা এক নিরন্তর ঘন্টাধ্বনি।
মনে পড়ে, বিভিন্ন সামাজিক ও সরকারি অনুষ্ঠান বা পার্বনে আমন্ত্রণের আনুষ্ঠানিকতার তোয়াক্কা না করে আজাদ তালুকদার ঠিকই আমার ‘ডিসিহিল’র বাংলোয় সস্ত্রীক উপস্থিত হতেন। প্রাণবন্ত আড্ডায় মেতে ওঠতেন, কন্ঠস্বরের উত্তাপের জোরে মুগ্ধতা ছড়াতেন। মানুষটি কোথাও নেই। ভাবতেই আমি কেমন যেনো কেবল ম্রীয়মান ও সংকুচিত
হয়ে যাই।
চার.
আজ তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে আমার অনিচ্ছাকৃত একটা অপরাধ বোধ ও অনুশোচনার কথা বলব। ২০২১ সালে আজাদ আমাকে তাঁর লেখা একটা উপন্যাসের পান্ডুলিপি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। উপন্যাসের নাম ‘নিগৃহীত সুন্দর ‘। তাঁর ধারণা ছিল এর জন্য একটা যুৎসই তথা মনোজ্ঞ ভূমিকা আমিই লিখে দিতে পারব। কিন্তু সময়টা ছিল আমার একেবারেই বৈরী। কিছু দিন আগে সহধর্মিণীকে হারাই, দীর্ঘ সরকারি চাকরির বিদায় ঘন্টা বাজছে, মাতৃহারা কনিষ্ঠ পুত্রের শারীরিক অসুস্থতা সব মিলিয়ে হঠাৎ দুঃসময়ের মুখোমুখি।
আজাদ তাঁর শরীরে বাস করা কর্কট রোগের কথা জানাল এবং একেই সঙ্গে ভূমিকাটি লিখে দেয়ার মোলায়েম তাগিদও দিলেন। আমি যতনে এড়িয়ে যাই এবং তাঁর চিকিৎসার কথায় গুরুত্ব দিই। না, আজাদ কিন্তু বারংবার ভূমিকার কথাই বললেন। আমি লজ্জিত হই। তাঁর এমন অসুখের কথা ভেবে বলতেও পারছি না যে, তাঁর প্রেরিত পান্ডুলিপিটা এখন আর ঘরে খুঁজে পাচ্ছি না। হয়তো পাঁচমিশালী কাগজপত্রের আড়ালে কোথাও লুকিয়ে আছে। তবে মনে আছে, পেয়েই বেশ কয়েক পৃষ্ঠা মনোনিবেশ নিয়ে পড়েছিলাম। বৃষ্টি নামের একটি মেয়ের সামাজিক কুসংস্কার ও আর্থিক প্রতিকুলতায় বেড়ে ওঠার এক করুণ গল্পগাথা নিয়ে এর কাহিনি এগিয়ে যায়।
পাঁচ.
আমি যদ্দুর জানি, পরবর্তীতে আমার লেখা ভূমিকা ছাড়াই বইটি প্রকাশিত হয়েছিল। কারণ আজাদ ছিলেন অবিরাম সৃষ্টিশীল, জেদি, আপসহীন, এক আবেগের নাম। নিজের মৃত্যু অবধারিত জেনেও তাঁর অনুপম সৃজনশীলতাকে মরতে দিতে চান নি।
তাঁর লেখালেখির পরিপক্বতা এবং কলা-কৌশলও ছিল দৃষ্টিতে পড়ার মতন। বিশেষ করে প্রমিত বানান রীতি, উপস্থাপনার শিল্পবোধ বা শিরোনাম নির্বাচনে তিনি ছিলেন দারুণভাবে রুচিশীল।
কী অবাক করা বিষয়, একদিন এক অলস সকালে পুরনো নথিতে হাত রাখতেই আকস্মিকভাবে আজাদ তালুকদারের উপন্যাসের পান্ডুলিপিটি পেয়ে যাই। আজাদ তখন জীবন-মৃত্যুর মাঝেখানের অদৃশ্য সুতোয় হাত রেখে চট্টগ্রাম-ঢাকা-মুম্বাই ছোটাছুটি করছিলেন। তখন অনেকের সঙ্গে আমিও তাঁর নিয়মিত ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে সেই দুখজাগানিয়া জীবনের গল্প অনুসরণ করে চলেছি।
ছয়.
প্রয়াত সাংবাদিক ও মানুষ আজাদ তালুকদারের জন্য অনিঃশেষ ভালোবাসা। তাঁর আত্মা শান্তি পাক।
হোসেন আবদুল মান্নান : লেখক, গল্পকার ও কলামিস্ট