৪৫-এ থেমে যাওয়া এক আলোকিত জীবন


সেকান্দর আলম বাবর : আজাদ তালুকদার একজন সাহসী সাংবাদিক, সংগঠক, লেখক এবং উদ্যোক্তা, যিনি প্রগতিশীল চিন্তাধারার একজন প্রতিনিধি। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে, আমি তাঁর একুশে পত্রিকায় প্রকাশিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনগুলো দূর থেকে পড়তাম। ২০১৮ সালের পরবর্তী রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে, যখন বোয়ালখালীর না বলা কথাগুলো গণমাধ্যমে তুলে ধরার সাহস কেউ করতেন না, তখন আজাদ তালুকদার তাঁর একুশে পত্রিকায় সাবলীল ভাষায় সেগুলো তুলে ধরেছেন।

তাঁর একুশে পত্রিকায় বোয়ালখালী সম্পর্কিত বেশ কিছু সংবাদ বোয়ালখালীবাসীকে নাড়া দিয়েছিল, আর আমিও অজান্তেই তাঁর একজন ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠাতেই তিনি তা গ্রহণ করেছিলেন। যদিও আমাদের কথোপকথন কখনো হয়নি, সম্পর্ক কেবল লাইক আর কমেন্টেই সীমাবদ্ধ ছিল।

আমি স্বপ্ন দেখতাম, চট্টগ্রামের জনপ্রিয় আঞ্চলিক পত্রিকা পূর্বকোণের পাশাপাশি বোয়ালখালীর অপরাধ সংক্রান্ত খবরগুলো ছদ্মনামে একুশে পত্রিকায় তুলে ধরার। কিন্তু কখনো তাঁকে সেই কথা বলার সুযোগ হয়নি।

আমার অগ্রজ, বাসসের সাংবাদিক জিগারুল ইসলাম জিগার ভাইয়ের কাছ থেকে আগেই আজাদ ভাইয়ের নম্বরটি নিয়ে রেখেছিলাম। ২০২২ সালের ২৩ নভেম্বর, শহর থেকে ফেরার পথে কালুরঘাট পার হয়ে নয়া রাস্তার মাথায় এসে এক সহকর্মীর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এমন সময় মনের অজান্তেই ফোন করে বসলাম আজাদ ভাইকে। যথারীতি তিনি ফোন রিসিভ করলেন। ফোনে নিজের পরিচয় দিতেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন আছেন? কী খবর? বোয়ালখালীর কী খবর? মোছলেম ভাই কেমন চালাচ্ছেন বোয়ালখালী?’ আমি বললাম, ‘ভালো।’ তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘তো আপনার কী খবর বলেন?’

আমি বললাম, ‘আপনার একুশে পত্রিকায় কাজ করতে চাই, বোয়ালখালী থেকে। আমি শিক্ষকতায় আছি, বেশি লোড নিতে পারব না।’ তিনি আর কিছু জানতে চাননি। বললেন, ‘আমার মেসেঞ্জারে নিউজ দেবেন।’ পরদিন সমসাময়িক বিষয় নিয়ে নিউজ করি। তিনি ঘণ্টাখানেক পর লিংকটা আমার মেসেঞ্জারে পাঠালেন। এভাবে চলল প্রায় এক পক্ষ। তিনি আমাকে একুশে পত্রিকার মেসেঞ্জার গ্রুপে অ্যাড করে নিলেন। আর কথা হয়নি।

২০২২ সালের ১৫ ডিসেম্বর আজাদ ভাই আমাকে কল দিয়ে বললেন, ‘১৭ ডিসেম্বর বিকেলে অফিসে আসবেন, প্রোগ্রাম আছে।’ যথারীতি অফিসে গেলাম। তিনি সাদরে গ্রহণ করলেন। কয়েকজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। মনে হলো তিনি আমাকে বহুদিন থেকে চেনেন। প্রোগ্রামটি ছিল উপজেলা পর্যায়ে সেরা প্রতিনিধিদের সম্মাননা অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে তিনি আমাকে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দিলেন। সাহস দিলেন কাজ করার। বললেন, ‘সমসাময়িক বিষয় থেকে গুরুত্ব বেশি দেবেন অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে।’ তাঁর এই আদেশ আমি মনে করি এতটুকুও পালন করতে পারিনি। তবে চেষ্টাও বন্ধ রাখিনি। এরপর একবার ফোনে কথা হয়, বিজ্ঞাপন-প্রতিবেদন ইত্যাদি নিয়ে।

২০২৩ সালের ৯ মার্চ শেষ দেখা। তাঁর রচিত ‘নিগৃহীত সুন্দর’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন। এক ঝাঁক গুণী ব্যক্তিদের মাঝে আমিও ছিলাম। কাশ্মীরি শালটি গায়ে দিয়ে তিনি অফিসে আসলেন। শরীর ও মনের অবস্থা জানতে চান আমার কাছে। কাছ থেকে দেখেও বুঝার সুযোগ ছিল না, তিনি দুরারোগ্য ক্যান্সারে ভুগছেন। দীর্ঘ ৩ ঘণ্টার বেশি অনুষ্ঠান কাটালাম। শখ ছিল তাঁর সাথে একটা ছবি তোলার। তাঁর ব্যক্তিত্ব, ছবি তোলা ও নিজেকে ফোকাসের প্রতি তাঁর এড়িয়ে চলার ভাব আমাকে সাহস দেয়নি বলতে, ‘ভাই, একটা সেলফি নিই।’

চলে আসার সময় এটুকু জিজ্ঞেস করতে তিনি ভোলেননি, ‘বাইক আনছেন? যাবেন কীভাবে?’ এটাই আমার জীবনে তাঁর সাথে শেষ দেখা। তাঁর ব্যক্তিত্ব, বহুমাত্রিক গুণ, মানুষের প্রতি ভালোবাসা আর একজন কর্মীর প্রতি স্নেহ-ভালোবাসা-সম্মানবোধ হাজার বছর তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে এই জনপদে।

৪৫-এ থেমে যাওয়াটা হয়তো সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছে। স্বল্প সময়ে তিনি সমাজ-অঞ্চল-দেশকে দেখিয়েছেন নিজ ক্ষেত্র থেকে আলোর পথ। আমি তাঁর আত্মার চিরশান্তি কামনা করি সর্বদা আর তাঁর ব্যক্তিত্বের শিক্ষাটা গ্রহণ করে এগিয়ে যেতে চাই অনেক দূর।

লেখক : বোয়ালখালী প্রতিনিধি, একুশে পত্রিকা।