শরীফুল রুকন : চট্টগ্রামের বুকে কেমন যেন একটা নতুন সুর বাজছে! রাজনীতির রঙ-এ ঢাকা দেয়ালগুলো আজ কেমন যেন জেগে উঠেছে এক অন্য আলোয়। ‘পানি লাগবে পানি?’, ‘আমাদের দেশের ভাগ্য আমরাই পরিবর্তন করবো’- এমন স্লোগানগুলো যেন বুকের ভেতর একটা আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে! শিল্প আর আবেগের এই মেলবন্ধনে শিশু থেকে বৃদ্ধ- সবার চোখ আজ একদিকেই।
ক্যালিওগ্রাফি আর গ্রাফিতির এই মায়াজালে যেন একটা গল্প লুকিয়ে আছে। বুধবার দুপুরে, কাঠফাটা রোদ, ঘাম ঝরছে তবুও থামছিল না শিক্ষার্থীদের হাতের তুলি। এই তো সেই স্বপ্ন! যে স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীনতার সৈনিকরা। ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’- এই স্লোগান যেন সেই স্বপ্নকেই জাগিয়ে তুলছে।
নগরের জিইসি মোড়ের দেয়ালগুলো আজ যেন এক সাক্ষী। কিছুদিন আগেও যেখানে ছিল অসুন্দরের ছাপ, আজ সেখানে যেন এক নতুন সূর্য উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুলের ছেলেমেয়েদের হাতের তুলিতে যেন ফুটে উঠেছে এক নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন। ‘এ শহর আর কাঁদবে না, অন্যায় আর থাকবে না’- এই আকাঙ্ক্ষা যেন সবার বুকের ভেতর এক নতুন আশার সঞ্চার করছে।
জিইসি মোড়ে অপরিচ্ছন্ন দেয়ালগুলো আজ শিক্ষার্থীদের হাতের তুলিতে রঙিন হয়ে উঠেছে। কালো, সাদা, লাল, নীল, হলুদ – এ যেন রঙের এক মেলা! বুধবার দুপুরে দেখা গেল, কেউ রঙ লাগাচ্ছে, কেউ পানি ছিটাচ্ছে- এ যেন এক মিলন মেলা! প্রতিটি মুখে যেন ফুটে উঠছে এক অনাবিল আনন্দ।
রোদের মধ্যেই যেন একটা মায়া লুকিয়ে আছে। কারও হাতে রঙের তুলি, কারও হাতে পানির বোতল- এ যেন এক স্বপ্নের রূপ! সবাই মিলে যেন একটা নতুন স্বপ্নের জন্ম দিচ্ছে। প্রতিটি ক্যালিগ্রাফির আঁচড়ে যেন ফুটে উঠছে এক নতুন বাংলাদেশের প্রত্যাশা।
জিইসি মোড়ে দেয়ালগুলো এখন যেন এক মহাকাব্যের পাতা! চোখ বুলিয়ে দেখা যায়, কোথাও দেশের প্রতি ভালোবাসায় উদ্বেলিত শিক্ষার্থীদের লেখা দেশাত্মবোধক গানের চরণ, যেন হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসা স্বদেশ প্রেমের সুর। কোথাও বা জাতীয় কবি শামসুর রাহমানের অমর কবিতার চরণ ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’, যা স্বাধীনতার জন্য আমাদের অবিরাম সংগ্রামের কথা মনে করিয়ে দেয়। আবার কোথাও বিদ্রোহী কবির সেই প্রতিবাদী কবিতার চরণ ‘বল বীর, বল বীর, বল উন্নত মম শির’, যা আমাদের মনে সাহস আর প্রতিরোধের আগুন জ্বালিয়ে দেয়।
কিছুদূর এগোতেই দেখা মিলল এক অন্যরকম দৃশ্য। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ। তার লাঠি হাতে যোদ্ধার মতো দাঁড়িয়ে থাকা সেই মুহূর্তের গ্রাফিতি যেন চোখের সামনে ভাসিয়ে তোলে তার বীরত্ব আর আত্মত্যাগের কাহিনী।
তাদের দেয়াল লিখনীতে ঠাঁই পেয়েছে সেই মায়াবী ডাক, যা আন্দোলনের উত্তাল সময়ে শিক্ষার্থীদের তৃষ্ণা মিটিয়েছিল, সাহস জুগিয়েছিল- ‘পানি লাগবে, পানি?’। সেই ১৮ জুলাই, রাজধানীর উত্তরা আজমপুরে মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ যখন ক্লান্ত শিক্ষার্থীদের মাঝে পানি বিলিয়ে দিচ্ছিলেন, তখনই নির্মম গুলি চলে। একটি গুলি এসে লাগে মুগ্ধর কপালে। মুহূর্তেই নিভে যায় তার জীবনের প্রদীপ, শুধু পড়ে থাকে তার স্বপ্ন আর আদর্শের অবিনশ্বর স্মৃতি।
অল্পবয়সী রাফির চোখে-মুখে আনন্দের ঝিলিক, ‘আমাদের এই দেয়ালগুলো যে কত অবহেলায় ছিল! এতদিন রাজনৈতিক স্লোগানে ভরে ছিল, কিন্তু আজ আমরা ক্যালিওগ্রাফি দিয়ে এক নতুন সাজ দিয়েছি। পথচারীরা থমকে দাঁড়িয়ে প্রশংসা করছেন, দেখতেও কত সুন্দর লাগছে! আমি এই কাজের অংশ হতে পেরে গর্বিত।’
বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুলের তরুণ-তরুণীরা যখন রঙ-তুলির মায়াবী ছোঁয়ায় ফুটিয়ে তুলছিল দেয়ালের নতুন রূপ, তখন এক পথচারীর চোখ পানি এলো। গলা ধরে এলো আবেগ, ‘বাহ্! এরাই তো স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার কারিগর! এদের দেখে আশায় বুক ভরে ওঠে।’