- ‘উন্নয়নের’ নামে কেইপিজেড কর্তৃপক্ষের পাহাড় কাটা অব্যাহত।
জিন্নাত আয়ুব : কেইপিজেড (কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন) কর্তৃপক্ষ পরিবেশবান্ধব হওয়ার দম্ভ করলেও বাস্তবে তারা পরিবেশের ওপর নির্মম ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে। কোনো জবাবদিহিতা ছাড়াই পাহাড় কেটে কারখানা বানাচ্ছে তারা। প্রকৃতির সুন্দর ভারসাম্য এভাবে মুহূর্তেই তারা নষ্ট করে দিচ্ছে। বন্যপ্রাণীরা তাদের আবাসস্থল হারিয়ে পথে বসছে। দেয়াং পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য এভাবে হারিয়ে যাচ্ছে চিরতরে।
কর্ণফুলী নদীর তীরে, চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও কর্ণফুলীতে বিস্তৃত কেইপিজেডের ৮০ শতাংশই পাহাড়ি এলাকা। এই সবুজ পাহাড় কেটেই গড়ে উঠছে কলকারখানার কংক্রিট জঙ্গল। প্রকৃতির নির্মম বিনাশ চলছে অবিরাম।
স্থানীয়রা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছেন, গত ১২ বছর ধরে কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ নির্বিচারে পাহাড় কেটে চলেছে। তাদের এই অমানবিকতা ও নিষ্ঠুরতার শেষ কোথায়?
প্রায় আড়াই হাজার একর জমিতে গড়ে ওঠা কেইপিজেডের কর্ণফুলী উপজেলার বড়উঠান, দৌলতপুর, আনোয়ারা উপজেলার বৈরাগ ইউনিয়নের মধ্য গুয়াপঞ্চক, বন্দর, উত্তর বন্দর, মোহাম্মদপুর, ফকিরখিল ও হাজিগাঁও এলাকায় পাহাড় কাটা চলছে!
দিনরাত খননযন্ত্রের করাল গর্জন! বড় উঠান থেকে আনোয়ারা বৈরাগ পর্যন্ত উঁচু পাহাড়গুলোকে নির্মমভাবে কেটে সমতল করা হচ্ছে। নদী তীরের দেয়াং পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য এখন অতীতের স্মৃতি। বাকি যে সবুজ টিলা-পাহাড়গুলো এখনও টিকে আছে, সেগুলোকেও কেটে মাটি ভরাট করে কারখানা, ইমারত আর রাস্তা বানানোর হিড়িক পড়েছে।
- দেয়াং পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য আজ বিলুপ্তির পথে, কারণ কেইপিজেড
কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ কিন্তু বুক ফুলিয়ে বলছে, তারা কিছুই করেনি! কেইপিজেডের সহকারী মহাব্যবস্থাপক মুশফিকুর রহমান নির্বিকার ভঙ্গিতে বলছেন, নতুন কারখানা গড়ে তুলতে কিছু টিলা কাটা হচ্ছে।
মুশফিকুর রহমানের কথায় যেন সত্যের প্রতি এক চরম অবজ্ঞা! তিনি বুক ফুলিয়ে বলছেন, ‘এখানে কোনো পাহাড় নেই।’ চোখের সামনে পাহাড় থাকতেও তিনি যেন অন্ধ! টিলা কেটেই আগে কারখানা বানানো হয়েছে, এখনো সেই ধ্বংসযজ্ঞ চলছে- এটাই যেন তাদের স্বাভাবিক কাজ!
জোনের মূল ফটকের কাছেই যে পাহাড় কাটা চলছে, তা দেখেও তিনি বলছেন, ‘ওখানে একটি লেক করা হচ্ছে।’ এই লেকের নামেই বুঝি প্রকৃতির বুক চিরে একের পর এক ক্ষত তৈরি করা হচ্ছে!
চারপাশে পাহাড়ের সারি, মাঝখানে কাটা অংশ যেন ক্ষতচিহ্ন! এত স্পষ্ট প্রমাণ সামনে থাকলেও তিনি সব অস্বীকার করছেন। উত্তর পাশের উঁচু পাহাড় কাটা নিয়ে প্রশ্ন করলেই আরেক মিথ্যা, ‘আইটি ভ্যালি গড়ে তোলা হবে।’ আর যে পাহাড় কেটে মাটি ফেলা হয়েছে, সেটা নাকি ইস্টার্ন রিফাইনারি কেটেছে!
কারখানার মূল কার্যালয়ের ২০০ মিটারের মধ্যেই যে ভবন গড়ে উঠছে, তার ভরাটের মাটি কোথা থেকে আসছে জানতে চাইলে মুশফিকুর রহমানের উত্তরেও যেন প্রকৃতির প্রতি চরম অবহেলা! তিনি বলছেন, ‘আমরা যেখানে ভবন বানাচ্ছি সেখানেই উঁচু টিলা ছিল। ওই টিলা কেটেই ভরাট করা হচ্ছে।’
তিনি দাবি করছেন, কেইপিজেডের পুরো এলাকায়ই নাকি শুধু টিলা, পাহাড় নেই! বরাদ্দ পাওয়ার আগে নাকি এলাকাটাই ছিল বিধ্বস্ত। তাদের কল্যাণেই নাকি এখন ৫২ শতাংশ জমিতে বনায়ন হয়েছে, লেক তৈরি হয়েছে। পরিবেশ নাকি অনেক উন্নত হয়েছে!
- হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করে চলছে কেইপিজেডের পাহাড় কাটা।
২৯ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে, এটা কি কম? এই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে তিনি যেন সব দায় এড়িয়ে যেতে চাইছেন। কিন্তু কর্মসংস্থানের নামে প্রকৃতির এত বড় ধ্বংস কি মেনে নেওয়া যায়? পাহাড় কাটা, পরিবেশ ধ্বংস নিয়ে প্রশ্ন তুললে নাকি সেটা ভালো দেখায় না!
বিদেশি কোম্পানিগুলোকে কারখানা করার অনুমতি দেওয়া নিয়েও তিনি যেন উদাসীন। তিনি বলছেন, ‘আমাদের বরাদ্দ পাওয়া জমিতেই তো আমরা বিদেশি কোম্পানিকে কারখানা করার অনুমতি দিয়েছি।’ এই সহজ স্বীকারোক্তি শুনে মনে হয়, দেশের প্রকৃতির চেয়ে তাদের কাছে বিদেশি বিনিয়োগই বড়।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী মতে, ‘শিল্পায়নের নামে দেয়াং পাহাড়সহ কেইপিজেডের পাহাড়গুলোকে অনেক আগেই ক্ষতবিক্ষত করে ফেলা হয়েছে। আনোয়ারার সাবেক ইউএনও শেখ জুবায়েরও একই কথা বলেছিলেন, কিন্তু কে শুনে কার কথা!’
কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ আবারও যদি পাহাড় কাটা শুরু করে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন আখতার কবির।
আনোয়ারার ইউএনও ইশতিয়াক ইমনকে এ ব্যাপারে জানানো হলেও তিনি কোনো মন্তব্য করেননি। তাঁর এই নীরবতা কি অনেক কিছু বলে দিচ্ছে না?
২০১২ সালে, পরিবেশ অধিদফতর কেইপিজেডের তিন শীর্ষ কর্মকর্তাসহ আরও সাত-আটজনের বিরুদ্ধে মামলা করে। পাহাড় কেটে পরিবেশ ধ্বংস এবং পরিবেশ আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে এই মামলা করা হয়। কর্ণফুলী থানায় পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক (ইনভেস্টিগেশন) আবদুর রাজ্জাক বাদী হয়ে এই মামলা দায়ের করেন।
অথচ পরিবেশ অধিদফতর ২০০৯ সালে ৩৩টি শর্তে কেইপিজেডকে পাহাড় কাটার অনুমতি দিয়েছিল! শর্তে স্পষ্ট বলা ছিল, অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী পাহাড় কাটা যাবে। কিন্তু কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ এসব শর্তের তোয়াক্কা না করে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে নির্বিচারে পাহাড় কেটেছে। শেষ পর্যন্ত হাইকোর্টকে এসে পাহাড় কাটা বন্ধের নির্দেশ দিতে হয়।
অর্থাৎ কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ শুধু নিজেদের লাভের কথা চিন্তা করে। পরিবেশের কথা, আইনের কথা তাদের কাছে কিছুই না।
- কেইপিজেডে প্রকৃতির বলিদান
চট্টগ্রাম দক্ষিণের বনবিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ-আল-মামুন বললেন, ‘কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ পাহাড়ের পাদদেশে কোনো রকম সুরক্ষা ব্যবস্থা না করেই নির্মমভাবে পাহাড় কেটে চলেছে। শিল্পায়নের নামে তারা প্রকৃতির বুকে একের পর এক ক্ষত তৈরি করছে।’
তার কথায় যেন দেয়াং পাহাড়ের আর্তনাদ শোনা যায়, ‘দেয়াং পাহাড়ের বুকে এক সময় হাতিরা ঘুরে বেড়াতো, মানুষের গ্রামে আসতো না তারা। কিন্তু এখন দেয়াং পাহাড়ের অস্তিত্বই মুছে দিয়েছে কেইপিজেড। বন্যপ্রাণীরা তাদের আশ্রয় হারিয়ে এখন দিশেহারা, অসহায়।’
দেয়াং পাহাড়ের সৌন্দর্য এখন শুধুই স্মৃতি। উঁচু পাহাড়গুলোকে কেটে সমতল করে দেওয়া হয়েছে। কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ-আল-মামুনের কথায় যেন প্রকৃতির প্রতি মানুষের নিষ্ঠুরতার চিত্র ফুটে ওঠে।
আনোয়ারা উপজেলা চেয়ারম্যান কাজী মোজাম্মেল হকের কণ্ঠে শোনা গেল একজন দায়িত্বশীল জনপ্রতিনিধির গভীর উদ্বেগ। তিনি বললেন, ‘আমাদের আগের ইউএনও সাহেবও কেইপিজেডের এই পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে অনেক চেষ্টা করেছিলেন। বর্তমান ইউএনও-ও বারবার সতর্ক করেছেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি, তারা পাহাড় কেটেই চলেছে!’
তার কথায় যেন একজন অসহায় মানুষের আর্তনাদ, ‘শুরু থেকেই কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ পাহাড় কেটে সাফ করে দিচ্ছে। পাহাড় হারিয়ে এখন বন্যপ্রাণীরা আশ্রয় খুঁজে পায় না, বাধ্য হয়ে লোকালয়ে চলে আসছে। জলাধার ভরাট হয়ে যাওয়ায় বর্ষায় পানি জমে মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে মানুষের যে কষ্ট হচ্ছে তা দেখে আমার বুক কেঁপে ওঠে। আমি অবশ্যই ইউএনও’র সাথে কথা বলব। এই পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে হবে।’
কেইপিজেডে ‘উন্নয়নের’ নামে প্রকৃতি ধ্বংসের বিষয়টি অবগত করা হয় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানকে; তবে তিনি এ বিষয়ে কিছু বলেননি।




