একুশে প্রতিবেদক : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) উপাচার্য পদে কে দায়িত্ব পাচ্ছে তা নিয়ে শুরু হয়েছে জল্পনা-কল্পনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন শিক্ষকের নাম শোনা যাচ্ছে।
তবে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের যেন এ পদে নিয়োগ প্রদান করা না হয়, সে দাবি জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বস্তরের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সাম্প্রতিক সময়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনে যেসব শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের পক্ষে ভূমিকা রেখেছেন, তাদের মধ্য থেকেই কাউকে উপাচার্য হিসেবে চাইছেন তারা।
জানা গেছে, অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির আন্দোলনের মুখে প্রফেসর ড. শিরীণ আখতারকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ‘আওয়ামী লীগ কোটায়’ গত ১৭ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য পদে নিয়োগ পান প্রফেসর ড. আবু তাহের। যিনি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য থাকাকালীন এ পদে নিয়োগ পান।
এর মধ্যে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হলে একপর্যায়ে ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হন শেখ হাসিনা। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তুলে আওয়ামী লীগ কোটায় নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্য প্রফেসর ড. আবু তাহেরের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে প্রফেসর ড. আবু তাহের ৯ আগস্ট পদত্যাগ করেন।
একইসাথে উপ উপাচার্য (একাডেমিক) প্রফেসর বেণু কুমার দে এবং উপ উপাচার্য (প্রশাসন) প্রফেসর ড. সেকান্দর চৌধুরীও পদত্যাগ করেন।
এরপর থেকেই প্রশাসনিক শূন্যতা দেখা দেয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগগুলোতে একাডেমিক কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। বন্ধ রয়েছে আবাসিক হলগুলো।
এ অবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শূন্য থাকা উপাচার্য পদে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও এই পদে নিয়োগ দিতে যাচ্ছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের প্রায় সবকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ হবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চমার্গের গবেষক হিসেবে স্বীকৃত, শিক্ষার্থীবান্ধব ও বিনয়ী আচরণের ব্যক্তিত্বই তারা উপাচার্য পদে দেখতে চান। যিনি অতীতের উপাচার্যদের মতো দলকানা স্বভাবের হবেন না। যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শুধু পড়াশোনার প্রতি খেয়াল রাখবেন না, তাদের নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে শাণিত করতে উদ্যোগী থাকবেন। যার কোনো লোভ থাকবে না। যিনি দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বিবেকের প্রতি দায়বদ্ধ থাকবেন। যার হাতে কোনো শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী নিগৃহীত হবে না। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী প্রত্যেকের অধিকার নিশ্চিত করতে তিনি কোনো চাপ অনুভব করবেন না। যিনি কারও দ্বারা প্ররোচিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিবেন না। যিনি কারও বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অবশ্যই যাচাই করবেন, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিবেন। রাগ কিংবা ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নিবেন না। প্রতিটি স্তরে ন্যায্যতা নিশ্চিত করবেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জাতির সামনে যে মেসেজ উত্থাপন করে দায়িত্ব পালন করছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে তার প্রতিফলন ঘটবে বলে আশা করছেন তারা।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পক্ষে যারা অবস্থান নিয়েছেন তাদের মধ্য থেকে জ্যেষ্ঠ কোনো প্রফেসরকে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ভাল হবে। এতে ন্যায্য অধিকার নিয়ে তিনি সোচ্চার থাকবেন।
জানা গেছে, কোটা সংস্কার আন্দোলন ইস্যুতে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন প্রফেসর ড. শামীম উদ্দিন খান। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক ঐক্যের প্রধান সমন্বয়ক ও সাদা দলের আহ্বায়ক। এছাড়া তিনি বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্যাটাগরিতে নির্বাচিত সিন্ডিকেট সদস্য ও ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক পদে কর্মরত। বিশ্ববিদ্যালয়ের বরিষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে তাঁর রয়েছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা। স্বভাবে বিনয়ী ও সদালাপী হওয়ায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী, সকলের মাঝেই রয়েছে তাঁর অবস্থান।
এছাড়া শিক্ষার্থীদের সঙ্গে থেকে সার্বক্ষণিক কোটা সংস্কার আন্দোলন আন্দোলন তত্ত্বাবধানে ছিলেন প্রফেসর ড. আতিয়ার রহমান। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের এই শিক্ষক উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেছেন জাপান, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ একাডেমি অফ সায়েন্সেসের ফেলো, এশিয়ান কাউন্সিল অব সায়েন্স এডিটরস’র সদস্য, ফেডারেশন অব এশিয়ান বায়োটেক এসোসিয়েশনের নির্বাহী সদস্য, বায়োমেড সেন্ট্রালের এডিটরিয়াল বোর্ড সদস্য, এশিয়া পেসিফিক কনসোর্টিয়াম অব রিসার্চার এন্ড এডুকেটরসের সদস্য বিশ্বের বিভিন্ন বিজ্ঞানীভিত্তিক সংস্থার সঙ্গে জড়িত। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিবিড় ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে এই শিক্ষকের বিশেষ খ্যাতি।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে আরও সম্পৃক্ত ছিলেন বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়া শিক্ষকদের অন্যতম আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. কামাল উদ্দিন।
যিনি হংকংয়ের নামকরা ‘University of HongKong’ থেকে ‘এনভায়রনমেন্ট এন্ড হিউম্যান রাইটস’ ইস্যু নিয়ে পিএইচডি সম্পন্ন করেছেন। সুইজারল্যান্ডের ‘University of Zurich’ থেকে তিনি উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেছেন।
তিনি বিশ্বের ৫০টিরও অধিক দেশে মানবাধিকার ইস্যুতে কনফারেন্স, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম এ আলোচক/অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালনের আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচিত সিন্ডিকেট সদস্য ছিলেন। এছাড়া দেশজুড়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধেসহ দেশের অরাজকতাপূর্ণ মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে একাডেমিক জায়গা থেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে কাজ করে চলেছেন প্রফেসর ড. কামাল উদ্দিন।
এছাড়া ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ড. তানভীর মোহাম্মদ হায়দার আরিফ এ আন্দোলনে প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব দিয়েছেন। যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচিত সিন্ডিকেট সদস্য ছিলেন। হলের প্রভোস্টসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে একমাত্র মোটিভেশনাল স্পিকার হিসেবে শিক্ষার্থীদের কাছে বেশ জনপ্রিয়।
এছাড়া দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোজাম্মেল হকও কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরু থেকে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সমাজ ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন কেন্দ্রের পরিচালক মোজাম্মেল হক বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রিয় শিক্ষকদের অন্যতম। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক স্থাপনের কারণে এই শিক্ষকের রয়েছে বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা।
এদিকে কোটা সংস্কারের দাবিতে পরিচালিত শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অংশ না নিলেও বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের কয়েকজন উপাচার্য পদে নিয়োগ পেতে দৌঁড়ঝাপ শুরু করেছে। তারা বিএনপি নেতাদের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন।
জানা গেছে, চবি জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক এস এম নছরুল কদির, একই দলের সদস্য প্রফেসর ড. আল আমিন, প্রফেসর ড. ফোরকান উপাচার্য পদে প্রার্থী।
এদিকে একাধিক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হতে আগ্রহী বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা। তাদের কেউ কেউ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সুবিধাভোগী ছিলেন, বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিসহ নানা দায়িত্বে ছিলেন।
শিক্ষার্থীদের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা ৮-১০ বছর আগে অবসর নিয়েছেন, তারা তাদের কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। ৩০ হাজার শিক্ষার্থীর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অবশ্যই নিয়মিত শিক্ষকই এই পদের যোগ্য। তাছাড়া অবসরপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তির প্রতিষ্ঠানের প্রতি দায়বদ্ধতা কাজ করে না।
এসব বিষয়ে অর্থনীতি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সৈয়্যদ মুহাম্মদ নুরাইন বলেন, ‘রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, আন্তরিক, সাহসী ও শিক্ষার্থীবান্ধব প্রশাসন চাই। যারা কোনো লেজুড়বৃত্তি কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকবেন না। শিক্ষার্থীদের স্বার্থে যদি সরকারের বিরুদ্ধেও যেতে হয়, তাহলেও তারা পিছপা হবেন না।’
বাংলা বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, রাজনৈতিক আদর্শের চেয়েও উপাচার্য পদে গুরুত্ব দিতে হবে যারা শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে সক্রিয় থেকেছে। যারা এই আন্দোলনে সক্রিয় ছিল না, তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান পদে আসীন হওয়ার নৈতিক অধিকার নেই। দুধের মাছিদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ হাজারো শিক্ষার্থীর খুনের বিনিময়ে আমরা দ্বিতীয় স্বাধীনতা পেয়েছি। এ স্বাধীনতা আনতে যারা আমাদের সহযোগী, তারাই আমাদের পিতার আসনে থাকবেন। আর অবসরপ্রাপ্তদের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার সিদ্ধান্ত হলে তা হবে আত্মঘাতী। কারণ এমনিতেই বিশ্ববিদ্যালয় পিছিয়ে গেছে। তার উপর কর্মক্ষম কেউ নেতৃত্বে আসে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় তার স্বকীয়তাই হারাবে। তাছাড়া অবসরপ্রাপ্ত কারও মধ্যে দায়বদ্ধতা কাজ করবে না।’