শরীফুল রুকন : বুধবার (২১ আগস্ট) অন্ধকার রাতের বুকে যখন সবাই নিশ্চিন্ত ঘুমে, তখনই নেমে আসে প্রলয়ংকারী বন্যার তাণ্ডব। নিমেষেই ঘোলা জলরাশি গ্রাস করে নেয় ফেনী, কুমিল্লা ও নোয়াখালীর সবুজ শ্যামল গ্রামগুলোকে। স্বপ্নের ঘরবাড়ি, সোনালী ফসলের ক্ষেত, সবকিছুই হারিয়ে যায় এক নির্মম জলসমাদের গর্ভে। অন্ধকার নেমে আসে, বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, কোটি কোটি মানুষের বুকের ওপর নেমে আসে অসহায়ত্বের কালো মেঘ।
হুড়মুড় করে বাড়তে থাকে পানি, সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার হুমকি। প্রিয়জন, গবাদিপশু, স্মৃতিবিজড়িত জিনিসপত্র, সবকিছুই হারানোর শঙ্কা। বাঁচার আকুতি, আর্তনাদে ভরে ওঠে চারদিক। ছাদের ওপর, টিনের চালে আশ্রয় নেয় হাজার হাজার মানুষ। খাদ্য নেই, বিশুদ্ধ পানি নেই, নেই কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা। শুধু অপেক্ষা, কখন আসবে সাহায্যের হাত?
এক দিনের ব্যবধানেই এই দুর্ভোগ ছড়িয়ে পড়ে চট্টগ্রামে ফটিকছড়ি, হাটহাজারী ও মিরসরাইয়ে। অসহায় মানুষের আর্তনাদে মন কাঁদে সবার। তবু থেমে থাকে না মানবতা। দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসে তরুণেরা, স্বেচ্ছাসেবীরা। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে তারা হাত বাড়িয়ে দেয় অসহায় মানুষের দিকে। শুরু হয় এক নিরলস লড়াই, বাঁচার লড়াই!
চট্টগ্রাম-ফেনীর বুকে বন্যার তাণ্ডব! চোখের সামনে সবকিছু ভেসে যাচ্ছে, ঘরবাড়ি, স্বপ্ন, আশা, সব। অসহায় মানুষের আর্তনাদে ফেটে পড়ছে বুক। কিন্তু, এ যেন এক অদ্ভুত সময়! মানবতার জয়গান গাইছে চারদিক। বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে ছুটে আসছেন অসংখ্য তরুণ, যুবক। বোঝাই ট্রাকে করে ত্রাণ নিয়ে ছুটছেন ফেনী, ফটিকছড়ির দিকে। তাদের সঙ্গে রয়েছেন সমাজের সর্বস্তরের মানুষ, যেন এক মহাসমুদ্র।
দু’চোখে ঘুম নেই তাদের, শুধু একটাই চিন্তা – কীভাবে বাঁচানো যায় অসহায় মানুষগুলোকে। পেট্রল পাম্পের মালিক দিচ্ছেন বিনামূল্যে তেল, মোবাইল অপারেটর দিচ্ছেন ফ্রি নেট, বহুতল ভবনের মালিক দিচ্ছেন আশ্রয়। সবাই যেন এক হয়ে গেছেন, জেগে উঠেছে বাংলাদেশ।
এই দুঃসময়েও মানুষ হারায়নি আশা। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে একে অপরকে। এ যেন এক ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের মাঝেও মানবতার এক অনন্য উদাহরণ।
মহাসড়কের বুক চিরে বয়ে যায় প্রলয়ংকরী স্রোত, যেন এক রক্তক্ষরণ। যান চলাচল থমকে যায়, স্থাপনাগুলো যেন কাঁদছে নিজের ধ্বংস দেখে। বন্যা কবলিত জনপদগুলো যেন বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপ, দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন, সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভেসে আসে হাহাকার, কান্নার রোল। বন্যার্ত মানুষের বেদনার ছবি দেখে চট্টগ্রামের বুক ফেটে যায়। অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে ছুটে যায় অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবক। জাহাজভাঙা এলাকা থেকে বোট সংগ্রহ করে, ট্রাকে করে ছুটে চলে ফেনী, ফটিকছড়ির দিকে। বৃষ্টি উপেক্ষা করে বোটের ওপর বসে থাকে যুবকের দল, যেন এক মহাকাব্যিক যুদ্ধে যাচ্ছে তারা।
ফেনী, মিরসরাই, ফটিকছড়ি, সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে তাদের মানবিকতার জোয়ার। শত শত স্বেচ্ছাসেবক ছুটে যাচ্ছে ত্রাণ নিয়ে, আরও অনেকে প্রস্তুতি নিচ্ছে। কেউ দিচ্ছে কাপড়, কেউ টাকা, কেউবা ঘরের রান্না করা খাবার। যেন এক অদৃশ্য শক্তি সবাইকে বেঁধে দিয়েছে এক সুতোয়। ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, ছাত্র, সবাই মিলে এক অভূতপূর্ব মহামিলনের সূচনা করেছে।
এ যেন শুধুই এক উদ্ধার অভিযান নয়, এ যেন এক জাতির নবজাগরণ। মানবতার যে জোয়ার এখন বইছে, তাতে হয়তো ভেসে যাবে সব অমানবিকতা, সব ক্ষুদ্রতা। হয়তো এই বন্যার জলরাশি ধুয়ে-মুছে নিয়ে যাবে সমাজের সব কালিমা, ফুটিয়ে তুলবে এক নতুন বাংলাদেশ।
“আমরা যতটুকু পারি, ততটুকুই করার চেষ্টা করছি।” কে আর শিপ রিসাইক্লিং ইয়ার্ডের স্বত্বাধিকারী মো. তসলিম উদ্দিনের কণ্ঠে এক অন্যরকম দৃঢ়তা, “বোট, লাইফ জ্যাকেট, সব দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছি আমরা। আমাদের ব্যবসায়ী ভাইয়েরাও এগিয়ে এসেছেন। এই দুঃসময়ে তাদের পাশে দাঁড়ানো তো আমাদের ঈমানেরই দায়িত্ব।”
তার চোখে জ্বলে ওঠে এক আশার আলো, “বাঙালি পারে, পারবেই- এ কথা আজ প্রমাণিত। যে মানুষ জীবনে এক কেজি জিনিসও তোলেনি, আজ সে-ই মাথায় করে পঞ্চাশ কেজির বস্তা নিয়ে ছুটছে পানির মধ্যে। এ যে মানবতার এক অভূতপূর্ব জাগরণ!”
“আমাদের ছেলেরা ফেনীর বুকে যুদ্ধ করছে, প্রতিটি মুহূর্ত প্রাণপণ লড়াই। কিন্তু এখনও অনেক মানুষ অন্ধকারে, পানির কবলে আটকা। যারা সাহায্যের হাত বাড়াতে চান, মোমবাতি নিয়ে আসুন, ফিটকারি নিয়ে আসুন, যেন আলোয় দেখা যায় তাদের মুখ, বিশুদ্ধ পানি পান করতে পারে তারা। খাবার, স্যালাইন নিয়ে আসুন, যেন বাঁচে তাদের প্রাণ। আর হে স্বেচ্ছাসেবক ভাইয়েরা, জনবহুল জায়গায় না গিয়ে দুর্গম এলাকায় ছুটে যান। সেখানেই আপনার অপেক্ষায় হাজারো প্রাণ।”- বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফির কণ্ঠে ছিল হাহাকার আর আকুল আবেদন।