নজরুল কবির দীপু : বন্যার পরবর্তী সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোতে বহুবিধ সমস্যা দেখা দেয়। যেমন, বন্যার প্রভাবে কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়। এছাড়াও কৃষকদের মধ্যে নতুন করে কৃষি উৎপাদন নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করে। দরিদ্র কৃষক ও বর্গাচাষীরা বীজ ও সারের উৎস নিয়ে অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হন। সুতরাং সাম্প্রতিক বন্যার পর কৃষি পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় সরকারকে অবিলম্বে মনোযোগ দিতে হবে।
এবারের মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও বন্যায় সমতল ভূমি থেকে শুরু করে পাহাড়ি অঞ্চল পর্যন্ত মোট ২৩টি জেলার কৃষিজ ফসল এবং ১৪.১৪ লাখেরও অধিক কৃষক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুসারে, আউশ ও আমন ধান, শাকসবজি এবং ফলের বাগান সহ বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন প্রায় ৯,৮৬,২১৪ মেট্রিক টন সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে। তবে সবচেয়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে ধান উৎপাদনে।
আমন ধানের চাষাবাদ ও বীজতলার যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা থেকে প্রায় ৭ লাখ মেট্রিক টন ধান পাওয়া যেত, যা সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়াও ১ লাখ মেট্রিক টন আউশ ধানের উৎপাদনও নষ্ট হয়েছে। সব মিলিয়ে আনুমানিক ২,৫১৯ কোটি টাকা মূল্যের ধান উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় বলছে, এখনো প্রায় ৭ লাখ পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে, যেখানে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৯ জনে এবং নিখোঁজ রয়েছেন আরও একজন।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের মতে, বর্তমান সময়ে সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো কৃষি পুনর্বাসন। এ কারণে ফসলহানির শিকার জমিগুলোকে দ্রুত চাষের উপযোগী করার কাজ ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। কৃষকদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য দেশের বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এগিয়ে এসেছেন। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিআরআরআই) ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) সহযোগিতায় তারা বীজ সংগ্রহ করছেন।
এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা ক্ষেত্রে আমন ধানের বীজতলা তৈরির কাজও শুরু হয়েছে। আমরা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের এই প্রয়াসকে সাধুবাদ জানাই।
এর আগে গত ২৪ আগস্ট, স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী কৃষি মন্ত্রণালয়সহ সব বিভাগের সঙ্গে একটি সভা করেন। সেখানে কৃষি পূনর্বাসনের জন্য বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভায় স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা বলেন, “সারের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকবে। কৃষকদের সারের কোনো সংকট হবে না।”
সেখানে আরও বলা হয়, বন্যাদুর্গত এলাকায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আমন ধানের উৎপাদন নিশ্চিত করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে। যেখানে আমন উৎপাদন সম্ভব নয়, সেখানে শাক-সবজিসহ উপযোগী অন্যান্য ফসল উৎপাদন নিশ্চিত করতে হবে।
দ্রুততম সময়ে আমনের বীজতলা তৈরি, বন্যা কবলিত এলাকার নিকটতম এলাকায় বীজতলা প্রস্তুত করা, মাঠ পর্যায়ে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা ও উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাগণকে বন্যাত্তোর কৃষি পুনর্বাসনের কার্যক্রম দ্রুততার সাথে শুরু করা, বন্যা কবলিত এলাকায় ব্লক এবং উপজেলা ভিত্তিক পুনর্বাসন পরিকল্পনা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেন উপদেষ্টা। এসব পদক্ষেপ অবশ্যই ইতিবাচক।
বন্যার কারণে অসংখ্য মাছের খামারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রতিটি জেলায় এই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কয়েক শত কোটি টাকা। মৎস ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর হিসাব করে দেখেছে— বন্যায় মাছ, মাছ চাষের অবকাঠামো এবং লাইভস্টক সেক্টরের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা।
খামারিদের দুর্দশা বিবেচনায় শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মাছের পোনা উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছেন। এই ধরনের সংবাদ আমাদেরকে অত্যন্ত আশাবাদী করে তোলে।
তবে কৃষকদের নিকট দ্রুত ও সঠিকভাবে বীজ এবং মাছের পোনা পৌঁছে দেওয়ার বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সবার একটাই আবেদন, ‘আমাদের আর কোনো কিছু দিতে হবে না। শুধু নতুন করে চাষ করার জন্য বীজ দিন। আমরা নিজেদের শ্রম দিয়ে কাজ শুরু করব।’
শুধু বীজ ও মাছের পোনা নয়, সরকারকে এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কৃষকদের কাছে কীভাবে সাশ্রয়ী মূল্যে সার পৌঁছে দেওয়া যায়। বন্যায় অনেকের হাঁস-মুরগি ও গরুর খামার সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে। বহু বন্যা কবলিত এলাকায় কোনো গবাদিপশু অবশিষ্ট নেই, সবই পানিতে ভেসে গেছে।
সরকারকে এখন খামারি কৃষকদের কথাও বিবেচনা করতে হবে। প্রণোদনা প্রদান অথবা স্বল্প সুদে ঋণের মাধ্যমে কৃষক ও খামারিদের পুনরায় স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।