নজরুল কবির দীপু : স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যমকে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। এটি কেবল একটি বাগধারা নয়, বরং গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার সুষ্ঠু কার্যকারিতার জন্য অপরিহার্য একটি উপাদান। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত হলে তবেই জনগণের কাছে সত্য তথ্য পৌঁছানো সম্ভব হয়, সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয় এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যম সরকার, রাজনৈতিক দল, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, এমনকি সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের কার্যকলাপের ওপর নজর রাখে এবং সে সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করে। এটি জনগণকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে এবং তাদেরকে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা প্রদান করে।
আমরা জানি, সরকারের নীতি ও কর্মকাণ্ডের ওপর স্বাধীন ও সমালোচনামূলক নজরদারি গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি। সংবাদমাধ্যম সরকারের ভুল-ত্রুটি, দুর্নীতি, অদক্ষতা তুলে ধরে এবং জনগণের কাছে সেগুলো প্রকাশ করে। এটি সরকারকে জনগণের প্রতি জবাবদিহি করতে বাধ্য করে। এছাড়া সংবাদমাধ্যম সমাজের অবহেলিত, নিপীড়িত মানুষের কথা তুলে ধরে এবং তাদের সমস্যাগুলো সমাজের সামনে তুলে ধরে। এটি সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
শুধু তাই নয়, স্বাধীন সংবাদমাধ্যম জনগণের মধ্যে সহনশীলতা, বহুত্ববাদ, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা, এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটায়। এটি একটি সুস্থ ও গতিশীল গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু অতীতে আমরা দেখেছি, সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়ই সংবাদমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। তারা সরকারের সমালোচনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশ বন্ধ করতে চেষ্টা করে, সাংবাদিকদের হুমকি দেয়, এমনকি তাদের গ্রেপ্তার করে। সরকার বা বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো বিজ্ঞাপন বা অন্যান্য আর্থিক সুবিধা দিয়েও সংবাদমাধ্যমকে প্রভাবিত করে। এমনকি সরকার কঠোর আইন প্রণয়ন করে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করেছে। মানহানি আইন, রাষ্ট্রদ্রোহ আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ইত্যাদি সংবাদমাধ্যমের ওপর অযৌক্তিক বিধিনিষেধ আরোপ করেছে।
এছাড়া সমাজের প্রভাবশালী গোষ্ঠী বা ব্যক্তিরাও সংবাদমাধ্যমের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। তারা নিজেদের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রতিবেদন প্রকাশ বন্ধ করতে বা তাদের পছন্দমতো প্রতিবেদন প্রকাশ করতে সংবাদমাধ্যমকে বাধ্য করে।
এমন অবস্থায় সম্পাদক পরিষদ ও প্রধান উপদেষ্টার সাম্প্রতিক বৈঠকটি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে আশার আলো জাগিয়েছে। মুক্ত সাংবাদিকতার পরিবেশ নিশ্চিত করার আহ্বান, সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেওয়ার আহ্বান, এমনকি স্বাধীন সংবাদমাধ্যম কমিশন গঠনের প্রস্তাবও ইতিবাচক। তবে অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে, কেবল সদিচ্ছার ওপর নির্ভর না করে, আইনি সংস্কারের মাধ্যমে এই প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন জরুরি।
আইসিটি আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, সাইবার নিরাপত্তা আইন – এই কালো আইনগুলো বাতিল বা সংশোধন ছাড়া স্বাধীন সাংবাদিকতা অধরা থেকে যাবে। এখনও সম্পাদক ও সাংবাদিকদের মাথায় ঝুলছে মামলার খড়্গ, প্রতি মাসে আদালতে হাজিরার ভোগান্তি। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের অতীতের লেখালেখি ও বক্তৃতা-বিবৃতি থেকে আইন সংস্কারের প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি স্পষ্ট। এখন সময় এসেছে সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যম কমিশন গঠনের প্রস্তাবকে স্বাগত জানাই, তবে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, অংশীজন ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এই কমিশন গঠন হওয়া জরুরি। অতীতের কমিশনগুলোর ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে, এই কমিশনকে সত্যিকারের স্বাধীন ও কার্যকর হতে হবে। জনগণের অর্থে পরিচালিত সংবাদমাধ্যমে সরকার ও বিরোধী পক্ষ, উভয়ের কথাই প্রচারের সুযোগ থাকতে হবে। সংবাদমাধ্যমে নির্ভয় ও নিঃশঙ্ক পরিবেশ নিশ্চিত করার এই সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে।
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা একটি গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য অপরিহার্য। এটি নিশ্চিত করার জন্য সরকার, রাজনৈতিক দল, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, এবং সমাজের সকল স্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সুরক্ষিত হলে তবেই আমরা একটি সুন্দর, ন্যায়বিচারপূর্ণ, এবং উন্নত সমাজ গড়ে তুলতে পারব।
আশা করি, অন্তর্বর্তী সরকার প্রয়োজনীয় আইনি সংস্কারের মাধ্যমে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করবে। একটি স্বাধীন ও সক্রিয় সংবাদমাধ্যম গণতন্ত্রের বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।