নজরুল কবির দীপু : গত সপ্তাহেও বাজারে চালের দাম বেড়েছে। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি চালের দাম দুই থেকে ছয় টাকা পর্যন্ত বেড়েছে, যা স্বাভাবিক নয়। চালের পাশাপাশি ব্রয়লার মুরগি ও ফার্মের ডিমের দামও বেড়েছে। তবে বন্যার প্রকোপ কমে যাওয়ায় সবজির বাজারে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে।
চালের দাম বৃদ্ধির ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন গরিব ও নিম্ন আয়ের মানুষ। গ্রামের মানুষ সাধারণত নিজেরাই সবজি উৎপাদন করে খান, তাই তাদের আয়ের বেশিরভাগই চাল কেনার পেছনে ব্যয় হয়। চালের দাম বাড়লে তারা বিপাকে পড়েন, আর দাম কমলে কিছুটা স্বস্তি পান।
নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে রাখতে সরকারের বাড়তি পদক্ষেপ প্রয়োজন ছিল। ৮ আগস্ট ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকার এই বিষয়ে কতটা পদক্ষেপ নিয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রথমত, চাহিদা অনুযায়ী বাজারে পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি। দ্বিতীয়ত, সীমিত আয়ের মানুষের কাছে বিকল্প উপায়ে কম দামে নিত্যপণ্য সরবরাহ করতে হবে।
অনেক দেশেই, এমনকি প্রতিবেশী ভারতেও, সরকার রেশনিং ব্যবস্থার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে কম দামে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ করে। বাংলাদেশেও একসময় এই ব্যবস্থা ছিল, তবে এর সুষ্ঠু বণ্টন নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। বর্তমানে সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় কিছু নিত্যপণ্য কম দামে সরবরাহ করলেও, প্রকৃত চাহিদার তুলনায় তা খুবই অপ্রতুল।
আগে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চালসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে বাজার সিন্ডিকেটের দোহাই দেওয়া হতো। ক্ষমতার পালাবদলের পর অনেক কিছু বদল হলেও বাজার সিন্ডিকেটের প্রভাব এতটুকু কমেছে, এর প্রমাণ নেই। পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি এখনও বিদ্যমান, শুধু চাঁদাবাজদের পদ্ধতি বদলেছে। পণ্যের দাম বৃদ্ধির জন্য ব্যবসায়ীরা উৎপাদন ও পরিবহন খরচের কথা বললেও, তা পুরোপুরি অসত্য নয়। দিনাজপুর থেকে ঢাকা বা চট্টগ্রামে পণ্য আনতে গেলে বিভিন্ন জায়গায় চাঁদা দিতে হয়, যা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়।
পণ্যের দাম বাড়লে নানা ধরনের ক্ষতি হতে পারে। কিছু প্রধান ক্ষতির মধ্যে রয়েছে: জনগণের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া। অর্থাৎ দাম বাড়লে মানুষের আয় একই থাকলেও তারা আগের তুলনায় কম পণ্য কিনতে পারেন। এতে তাদের জীবনযাত্রার মান কমে যায়। বিশেষ করে সীমিত আয়ের মানুষেরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এছাড়া পণ্যের দাম বাড়তে থাকলে সামগ্রিকভাবে মুদ্রাস্ফীতির সৃষ্টি হয়। মুদ্রাস্ফীতি অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। এর ফলে সঞ্চয়ের মূল্য কমে যায়, বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হয় এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়। শুধু তাই নয়, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে জনগণের মধ্যে অসন্তোষ বাড়তে পারে। চরম ক্ষেত্রে এটি সামাজিক অস্থিরতা, এমনকি দাঙ্গা-হাঙ্গামার সৃষ্টি করতে পারে।
তাছাড়া দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। ক্রয়ক্ষমতা কমে গেলে চাহিদা কমে যায়, যা উৎপাদন ও বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি দারিদ্র্যের অন্যতম প্রধান কারণও। দাম বাড়লে অনেক মানুষের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনাও কষ্টকর হয়ে পড়ে। এছাড়াও পণ্যের দাম বাড়লে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়, রপ্তানি কমে যেতে পারে এবং সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর বড় সংস্কারের দাবি উঠলেও নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে তা কার্যকর হবে না। দুঃখজনকভাবে সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, ফলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ট্রাকে করে খোলাবাজারে পণ্য বিক্রি খুব কমই দেখা যায়, এ অবস্থায় দাম নিয়ন্ত্রণ করা প্রায় অসম্ভব।
অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের মতে, নিত্যপণ্যের দাম কয়েক মাসের মধ্যে কমবে। তবে, গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষের জন্য এই সময় অপেক্ষা করা কঠিন হতে পারে। তাই, তাদের জন্য নিত্যপণ্য যেমন চাল, ডাল, আটা, ভোজ্যতেল ইত্যাদি সাশ্রয়ী মূল্যে কেনার ব্যবস্থা করা জরুরি।
জ্বালানি তেলের দাম কিছুটা কমলে কৃষি ও শিল্পপণ্যের উৎপাদন এবং পরিবহন খরচ কমবে বলে আশা করা যায়। বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারকে বিচ্ছিন্ন ও লোকদেখানো উদ্যোগ নয়, বরং কার্যকর ও টেকসই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।