সোমবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ২৯ আশ্বিন ১৪৩১

বিচারিক ক্ষমতা পাওয়ায় যা যা করতে পারবেন সেনা কর্মকর্তারা

প্রকাশিতঃ ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৪:১৮ অপরাহ্ন


ঢাকা : সেনাবাহিনীর কমিশন্ড কর্মকর্তাদের বিশেষ বিচারিক ক্ষমতা প্রদানের ফলে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭টি ধারা আলোচনায় এসেছে। এই ক্ষমতাবলে সেনা কর্মকর্তারা আগামী ৬০ দিন এসব ধারার অধীনে অপরাধের বিচার ও শাস্তি প্রদান করতে পারবেন।

শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের ৪০ দিন পর সেনাবাহিনীকে এই বিচারিক ক্ষমতা দিল। যদিও সেনাবাহিনী দুই মাস আগে থেকেই বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করছে, তবে এখন তারা বিচারিক ক্ষমতাও প্রয়োগ করতে পারবে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট থেকে ওপরের পদমর্যাদার সেনা কর্মকর্তারা ফৌজদারি কার্যবিধির নির্দিষ্ট ৬৪, ৬৫, ৮৩, ৮৪, ৮৬, ৯৫ (২), ১০০, ১০৫, ১০৭, ১০৯, ১১০, ১২৬, ১২৭, ১২৮, ১৩০, ১৩৩ ও ১৪২ ধারার অধীনে অপরাধের বিচার করতে পারবেন। এই ক্ষমতার আওতায় তারা তল্লাশি, গ্রেপ্তার, বিচার ও জামিন প্রদান, সমাবেশ বন্ধ করাসহ বিভিন্ন কাজ করতে পারবেন।

সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট থেকে ওপরের পদধারীরা এই বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ পাচ্ছে। এই ক্ষমতার বলে তারা কোথাও তল্লাশি, গ্রেপ্তার, নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে বিচার ও জামিন, কোনও সমাবেশ বন্ধ করতে পারবে।

ফৌজদারি আইনের বিশেষজ্ঞ আইনজীবীরা জানিয়েছেন, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা পাওয়া সেনা কর্মকর্তারা এখন নির্দিষ্ট ধারায় অপরাধীকে গ্রেপ্তার বা গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিতে পারবেন এবং বিভিন্ন মেয়াদে সাজাও দিতে পারবেন।

ঢাকার সাবেক মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর এহসানুল হক সমাজী ব্যাখ্যা করেছেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ১২ (১) উপধারা অনুসারে, সরকার যেকোনো ব্যক্তিকে মেট্রোপলিটন এলাকার বাইরে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দিতে পারে। এই ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে কাজ করবেন।

কোন ধারায় কী ক্ষমতা

ধারা ৬৪: ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে অপরাধ সংঘটনকারী ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করার বা গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেওয়ার এবং হেফাজতে রাখার ক্ষমতা।

ধারা ৬৫: গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা বা তার উপস্থিতিতে গ্রেপ্তারের নির্দেশনা যার জন্য, তিনি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে পারবেন।

ধারা ৮৩, ৮৪ ও ৮৬: ওয়ারেন্ট অনুমোদন করার ক্ষমতা বা ওয়ারেন্টের অধীনে গ্রেপ্তার অভিযুক্ত ব্যক্তিকে অপসারণের আদেশ দেওয়ার ক্ষমতা।

ধারা ৯৫(২): নথিপত্র ইত্যাদির জন্য ডাক ও টেলিগ্রাফ কর্তৃপক্ষের দ্বারা অনুসন্ধান এবং আটক করার ক্ষমতা।

ধারা ১০০: ভুলভাবে বন্দি ব্যক্তিদের হাজির করার জন্য অনুসন্ধান-ওয়ারেন্ট জারি করার ক্ষমতা।

ধারা ১০৫: সরাসরি তল্লাশি করার ক্ষমতা, তার (ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি) উপস্থিতিতে যে কোনও স্থানে অনুসন্ধানের জন্য তিনি সার্চ ওয়ারেন্ট জারি করতে পারেন।

ধারা ১০৭: শান্তি বজায় রাখার জন্য নিরাপত্তার প্রয়োজনীয় ক্ষমতা।

ধারা ১০৯: ভবঘুরে এবং সন্দেহভাজন ব্যক্তির ভালো আচরণের জন্য নিরাপত্তার প্রয়োজনীয় ক্ষমতা।

ধারা ১১০: ভালো আচরণের জন্য নিরাপত্তার প্রয়োজনীয় ক্ষমতা।

ধারা ১২৬: জামিনের নিষ্পত্তি করার ক্ষমতা।

ধারা ১২৭: বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করার আদেশদানের ক্ষমতা।

ধারা ১২৮: বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করার জন্য বেসামরিক শক্তি ব্যবহার করার ক্ষমতা।

ধারা ১৩০: বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করার জন্য সামরিক শক্তি ব্যবহার করার ক্ষমতা।

ধারা ১৩৩: স্থানীয় উপদ্রবে ক্ষেত্রবিশেষে ব্যবস্থা হিসেবে আদেশ জারি করার ক্ষমতা।

ধারা ১৪২: জনসাধারণের উপদ্রবের ক্ষেত্রে অবিলম্বে ব্যবস্থা হিসেবে আদেশ জারি করার ক্ষমতা।

এসব ধারায় অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে দণ্ডবিধির সুনির্দিষ্ট কিছু ধারা অনুসরণ করা হয় বলে জানান জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী।

তিনি বলেন, দণ্ডবিধির কতগুলো ধারা অনুসরণ করে সেনাবাহিনীর কমিশন্ড কর্মকর্তারা এই ৬০ দিন একজন নির্বাহী ম্যাজিট্রেটের মতোই বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন।

“ফৌজদারি কার্যবিধির দ্বিতীয় তফসিলে বর্ণিত এই ধারাগুলোর অধীনে অপরাধগুলো কী, সর্বোচ্চ অথবা সর্বনিম্ন শাস্তি কী, তা সশ্রম বা বিনাশ্রম কিংবা অর্থদণ্ডে হবে? অর্থাৎ অপরাধের প্রকৃতি, অপরাধের শাস্তির পূর্ণাঙ্গ চিত্র আমরা পাই।”

তবে যে অভিযুক্ত ব্যক্তির স্বীকারোক্তির পরই কেবল সাজা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে জানিয়ে একজন নির্বাহী হাকিম বলেন, “একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তার উপস্থিতিতে সংঘটিত অপরাধ বা ঘটনাস্থলে তার বা তার সামনে উন্মোচিত হওয়া অপরাধগুলো বিবেচনায় নেন। আর সাজা দেন অভিযুক্ত ব্যক্তির স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে।”

বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করতে বিভিন্ন সময়ে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সহায়তা নেয় সরকার। জাতীয় নির্বাচনের সময়গুলোতেও সেনা মোতায়েন হয়ে থাকে। তবে তখন সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া হয় না।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন তীব্র হলে মধ্য জুলাইয়ে পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি সদস্যদের মোতায়েন করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। তাতেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না এলে ১৯ জুলাই সারাদেশে সান্ধ্য আইন জারির পাশাপাশি মোতায়েন করা হয় সেনাবাহিনী।

সে সময় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তার জন্য মাঠে নামে ২৭ হাজার সেনা সদস্য নামানো হয়েছিল। তবে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া হয়নি।

এরপর নানা ঘটনা পরিক্রমার মধ্য দিয়ে গেছে দেশ। তীব্র আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয় ড. ইউনূসের নেতৃত্বে।

তবে তখন দেশের বিভিন্ন স্থানে চলছিল অরাজক পরিস্থিতি। থানাগুলোয় হামলা, লুটপাট ও হত্যার ঘটনা ঘটলে নিরাপত্তার স্বার্থে কর্মস্থল ছেড়ে যান পুলিশ সদস্যরা। সেই অবস্থায় ভেঙে পড়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। ফলে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে থানার নিরাপত্তার দায়িত্বও নেয় সেনা সদস্যরা।

তখন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ জামান বলেছিলেন, পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা সংগঠিত হয়ে স্বাভাবিক কাজ শুরু করলে সেনা সদস্যরা ব্যারাকে ফেরত যাবে।