নজরুল কবির দীপু : বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একটি প্রতিশ্রুতিশীল প্রতিষ্ঠান যেখানে সেবা, বীরত্ব এবং জনকল্যাণের জন্য নিরন্তর কাজ করা হয়। সেই সেবার চূড়ান্ত উদাহরণ হয়তো হয়ে উঠতে পারেন লেফটেন্যান্ট মো. তানজিম সারোয়ার নির্জন, যিনি গতকাল সোমবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে কক্সবাজারের চকরিয়ায় ডাকাতির সময় অভিযানে গিয়ে প্রাণ হারান। ২৩ বছর বয়সী তানজিম ছিলেন একজন উদীয়মান সেনা কর্মকর্তা, যার কর্মজীবন এবং জীবনকালের এই অকাল সমাপ্তি আমাদের দেশের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে গভীর শোকের বার্তা বহন করে।
তানজিম সারোয়ারের জীবন এবং তাঁর মৃত্যু শুধু একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়, বরং এটি আমাদের জাতীয় সুরক্ষার প্রতিটি দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির জীবনের ঝুঁকি এবং আত্মত্যাগের প্রতিফলন। তাঁর মৃত্যু কেবলমাত্র একটি অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা নয়, এটি বীরত্বের প্রতীক হিসেবে আমাদের সবার সামনে তুলে ধরা উচিত। তিনি দেশের জন্য, মানুষের নিরাপত্তার জন্য এবং একটি সাধারণ পরিবারকে রক্ষা করতে গিয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন।
লেফটেন্যান্ট তানজিম সারোয়ারের মৃত্যুর দিনটি ছিল আরেকটি সাধারণ রাত, যেদিন তিনি নিজের কর্তব্য পালনে বের হয়েছিলেন। তাঁর কর্মজীবন খুব অল্পদিনের হলেও, তাঁর প্রতিশ্রুতি ও দায়িত্ববোধ ছিল গভীর। তিনি সেনাবাহিনীর একটি অভিযানে অংশ নেন, যেখানে ডাকাতির প্রস্তুতি ঠেকানোর জন্য সেনাবাহিনী ও পুলিশের যৌথ বাহিনী কাজ করছিল। ঘটনাস্থলে তানজিম ছিলেন ডাকাতদের আটকানোর প্রথম সারির একজন।
এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ছিল, যেখানে তানজিম একজন ডাকাতকে ধাওয়া করে ধরে ফেলেন। কিন্তু সেই ডাকাত অতর্কিতভাবে তানজিমকে ছুরিকাঘাত করে, মাথা ও গলায় গুরুতর আঘাত করে। এই আক্রমণ সত্ত্বেও, তিনি একজন দায়িত্বশীল ও সাহসী বীরের মতো ডাকাতকে ধরে রাখার চেষ্টা করছিলেন।
এই ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রতিটি সেবাদানকারী ব্যক্তি যখন নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য অভিযানে বের হন, তাঁরা জীবন হাতে নিয়ে ঝুঁকি নেন। তানজিম সারোয়ারের এই আত্মত্যাগ আমাদের শিক্ষা দেয় যে, দেশের জন্য নিবেদিত দায়িত্ব কতটা কঠিন হতে পারে।
তানজিমের মৃত্যু তাঁর পরিবারের জন্য একটি অপরিসীম শোকের কারণ। মাত্র ২৩ বছর বয়সে এক সুদূরপ্রসারী ভবিষ্যতের মুখে দাঁড়ানো তানজিমের পরিবার হয়তো তাঁকে দেশের সেবা করতে দেখার গর্বিত আশা নিয়ে ছিল। তাঁর বাবা-মা, ভাই-বোনরা যেমন হারিয়েছেন তাঁদের প্রিয় একজনকে, তেমনি বাংলাদেশও হারিয়েছে একটি উজ্জ্বল তারকাকে।
তাঁর মা-বাবার চোখে হয়তো আজ ভাসছে সেই স্বপ্ন, যেখানে তাঁরা তানজিমকে দেখতেন দেশের জন্য আরও বড় দায়িত্ব নিতে। তানজিমের মতো তরুণেরা শুধু তাঁদের পরিবারের জন্য গর্ব নয়, তাঁরা জাতির সম্পদ।
তানজিম সারোয়ারের মতো সাহসী সৈনিকদের আত্মত্যাগ আমাদের সেনাবাহিনীর প্রতি আরও গভীর শ্রদ্ধা এবং সমর্থন যোগায়। আমাদের সেনাবাহিনী দিনের পর দিন দেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে জীবনের ঝুঁকি নেয়। এ ধরনের ঘটনা আমাদের সেনাবাহিনীর সদস্যদের আত্মত্যাগের মূল্য কতটা বেশি তা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়।
একইসাথে, এই ঘটনা আমাদের সমাজ এবং রাষ্ট্রকে মনে করিয়ে দেয় যে, তাঁদের পাশে দাঁড়ানো, তাঁদের প্রয়োজনীয় সহায়তা এবং শ্রদ্ধা প্রদান করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। যখন আমরা তাঁদের বীরত্ব ও সেবা স্বীকার করি, তখনই আমরা তাঁদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে পারি।
লেফটেন্যান্ট তানজিম সারোয়ারের মৃত্যু আমাদের সেনাবাহিনীর প্রতিটি সদস্যের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। তাঁর বীরত্ব এবং আত্মত্যাগের উদাহরণ আমাদের সবার কাছে উজ্জ্বল এক প্রতীক হিসেবে রয়ে যাবে।
লেফটেন্যান্ট তানজিম সারোয়ারের মৃত্যু শুধু একটি ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, এটি পুরো দেশের জন্য একটি বেদনাদায়ক শিক্ষা। তাঁর মৃত্যু আমাদের আবারও মনে করিয়ে দেয় যে, জাতির সুরক্ষা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে, প্রতিদিন সেনা সদস্যরা কতোটা বড় ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন। যখন একজন সেনা কর্মকর্তা দেশের জন্য জীবন দেয়, তখন সেই আত্মত্যাগের মূল্যায়ন শুধুমাত্র তাঁর পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং তা পুরো জাতির জন্য গর্বের কারণ হয়ে ওঠে।
তানজিমের আত্মত্যাগ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমরা নিরাপত্তা ও সুরক্ষার মাঝে বসবাস করতে পারছি কারণ কেউ না কেউ আমাদের জন্য সেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিজের জীবনকে তুচ্ছ করছেন। একজন সেনা কর্মকর্তার জীবন মানেই শুধু চাকরি নয়, এটি একটি সারাজীবনের সংকল্প, একটি আদর্শ। তানজিম সেই আদর্শের প্রতিনিধিত্ব করেছেন, তাঁর কাজ এবং দায়িত্বের মাধ্যমে।
তাঁর আত্মত্যাগের ঘটনাটি কেবল শোকের বিষয় নয়, বরং এটি আমাদের দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার গর্ব এবং সেই গর্বের সাথে যুক্ত থাকা কঠিন সংগ্রামগুলোরও প্রতিচ্ছবি। দেশে শান্তি বজায় রাখতে যে সকল বাহিনী প্রতিনিয়ত কাজ করছে, তাঁদের বীরত্বের উদাহরণ হিসেবে তানজিম সারোয়ারের এই আত্মত্যাগ জাতির হৃদয়ে অমর হয়ে থাকবে।
অন্যদিকে, এই ঘটনা আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার সার্বিক পরিকল্পনার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যেহেতু ডাকাতি ও অন্যান্য অপরাধ কার্যকলাপ প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে, তাই সমাজে আরও নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়েছে। যৌথ বাহিনী কীভাবে স্থানীয় পর্যায়ে কার্যকরভাবে কাজ করে, তার এই উদাহরণ প্রশংসনীয় হলেও, এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় আরও সতর্ক ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।
তানজিমের মতো সেনা সদস্যদের আত্মত্যাগ শুধু একটি দায়িত্ব পালনের ঘটনা নয়, এটি দেশপ্রেমের এক অমূল্য নিদর্শন। একজন দেশপ্রেমিক ব্যক্তি হিসেবে তানজিম দেশের মানুষের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। আমরা, যারা নিরাপদে জীবনযাপন করছি, তাঁদের উচিত এই ধরনের বীরত্বের কাহিনী স্মরণ রাখা, এবং দেশের প্রতিটি সেবাদানকারী সদস্যকে সম্মান জানানো।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।