বৃহস্পতিবার, ৩ অক্টোবর ২০২৪, ১৮ আশ্বিন ১৪৩১

সমবায় ব্যাংকের স্বর্ণচুরি: ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রয়োজন

বিশেষ সম্পাদকীয়

প্রকাশিতঃ ১ অক্টোবর ২০২৪ | ৯:১৬ পূর্বাহ্ন


নজরুল কবির দীপু : সম্প্রতি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছেন, যা ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতির জটিলতা এবং গভীর সমস্যাগুলোর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি জানিয়েছেন, সমবায় ব্যাংকের ১২ হাজার ভরি স্বর্ণের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। একই সঙ্গে, সমবায় ব্যাংকের বহু সম্পত্তি বেদখল হয়ে গেছে। এ ঘটনাগুলো শুধু একটি বিচ্ছিন্ন দুর্নীতির উদাহরণ নয়, বরং সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা দুর্নীতির নীতিহীন সংস্কৃতির প্রমাণ।

অভিযোগটি আরও গুরুতর হয় যখন জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ কো-অপারেটিভ ক্রেডিট লিমিটেড এক সময় সমবায় ব্যাংকে ১৩ হাজার ২২৫ ভরি স্বর্ণ জামানত রেখে ঋণ গ্রহণ করেছিল। দীর্ঘ ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই ঋণ পরিশোধ হয়নি। চিঠি দিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি, এবং সেই সুযোগে ব্যাংকের এক চক্র মিথ্যা পরিচয়পত্র ব্যবহার করে গ্রাহকের নামে ভুয়া আবেদন সাজিয়ে স্বর্ণ আত্মসাৎ করেছে। বিষয়টি শুধু দুর্নীতি নয়, বরং এ ধরনের প্রতারণা ব্যাংকিং সিস্টেমের নৈতিক পতন ও জবাবদিহিতার অভাবকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। প্রায় দুই হাজার ভুয়া আবেদনের মাধ্যমে এই চক্র স্বর্ণ ফেরত নেয়ার চেষ্টা করেছিল, যা ব্যর্থ হয়েছে।

এ ধরনের প্রতারণা কেবলমাত্র আর্থিক ক্ষতি নয়, বরং তা দেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। জুয়েলারি সমিতির মূল্য তালিকা অনুযায়ী, ১২ হাজার ভরি স্বর্ণের ক্ষতি হিসেবে ধরা হয়েছে প্রায় ৩১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এই বিশাল পরিমাণ অর্থ এবং সম্পদের ক্ষতি শুধু ব্যাংক বা গ্রাহকদের জন্য নয়, দেশের অর্থনীতির জন্যও এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়।

একটি রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক ভিত্তি দুর্বল হলে সেই রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়ে যায়। স্বর্ণচুরি এবং এর সঙ্গে জড়িত চক্রের কার্যকলাপ আমাদের অর্থনীতির বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ব্যাংকিং খাতে এমন প্রতারণার ঘটনা দেশের আন্তর্জাতিক সুনামকেও ক্ষুণ্ণ করে।

গত ১৫ বছরে ব্যাংকিং খাতে যে অনিয়ম ও দুর্নীতির মহোৎসব চলছে, তা সমবায় ব্যাংকের এই স্বর্ণচুরি ঘটনার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকে যে দুর্নীতির খবর পাওয়া গেছে, তা এই ঘটনার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। ব্যাংকগুলোর দুর্নীতিবাজ চক্র এবং বাইরের অসাধু ব্যবসায়ীদের যোগসাজশে কোটি কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। কিন্তু সেই অর্থ আত্মসাৎ করার ঘটনা সুনির্দিষ্ট আইনি প্রক্রিয়ায় আলোচনায় না আসায় দুর্নীতিবাজরা সুরক্ষিত রয়ে গেছে।

সমবায় ব্যাংকের ক্ষেত্রে টাকার পরিবর্তে স্বর্ণ আত্মসাৎ করা হয়েছে, যা একটি ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা। জনগণের মূল্যবান সম্পদ স্বর্ণ চুরির এই ঘটনা আমাদের সামনে দুর্নীতির প্রকৃতি এবং এর পরিণতির ভয়াবহতা তুলে ধরে। সমবায় ব্যাংকের স্বর্ণচুরির এই ঘটনা শুধু একটি চুরির ঘটনা নয়, বরং একটি দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থার উন্মোচন।

এখন প্রশ্ন হলো, এ ধরনের প্রতারণার পরিণাম কী হবে? উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ জানান, যারা ব্যাংকের সম্পত্তি বেদখল করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়া কতটা কার্যকরী হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। সমবায় ব্যাংকের স্বর্ণ খোয়া যাওয়ার ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় এনে সঠিক বিচার করা জরুরি।

এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, আইনশৃঙ্খলার অভাব এবং দুর্নীতির প্রতি নমনীয়তা কেবল ব্যাংকিং খাতকেই দুর্বল করেনি, বরং রাষ্ট্রের আর্থিক কাঠামোকেও ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। এমনকি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিরাও এই দুর্নীতিতে জড়িত থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

আমাদের আশাবাদ, বর্তমান সরকার ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতির প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় আনবে। দেশের বাইরের ব্যাংক বা সংস্থাগুলোর মাধ্যমে পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, এবং এই উদ্যোগে সাফল্য কামনা করছি। বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ও সম্পদ ফেরত আনার মধ্য দিয়ে এই সমস্যা মোকাবিলায় কিছুটা সাফল্য অর্জিত হতে পারে।

তবে শুধু অর্থ ফেরত আনাই যথেষ্ট নয়, ব্যাংকিং খাতে যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন, তা আরও গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাংকগুলোর পরিচালনগত কার্যক্রমে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি, আইনি কাঠামোতে সংস্কার আনা অত্যাবশ্যক। ব্যাংকগুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে প্রভিশন এবং মূলধন ঘাটতির সমাধান করতে হবে।

সমবায় ব্যাংকের হারিয়ে যাওয়া স্বর্ণের সঠিক তদন্ত এবং স্বর্ণ উদ্ধার করে প্রকৃত মালিকদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। এটি কেবল একটি প্রতীকী পদক্ষেপ নয়, বরং পুরো ব্যাংকিং খাতে নৈতিকতার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সহায়ক হবে।

যত দিন পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতির জাল বিস্তৃত থাকবে, তত দিন দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। ব্যাংকিং খাতে যেসব ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হল মূলধন পর্যাপ্ততা কম থাকা, প্রভিশন ঘাটতি বেশি থাকা, এবং দুর্নীতি মোকাবিলায় পর্যাপ্ত রিজার্ভ তহবিলের অভাব।

আমাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নৈতিকতার ঘাটতি রয়েছে, যার কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। যদি এই সমস্যাগুলোর যথাযথ সমাধান না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হতে হতে পারে দেশ।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে যে সংকট চলছে, তা শুধু অর্থনৈতিক নয়, বরং একটি সামাজিক ও নৈতিক সংকটের প্রতিফলন। সমবায় ব্যাংকের স্বর্ণচুরির ঘটনা সেই দুর্নীতির একটি উদাহরণ মাত্র। সঠিক তদন্ত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে রক্ষা করা সম্ভব। এজন্য শুধু সরকার নয়, সাধারণ জনগণকেও সচেতন হতে হবে এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।

সমবায় ব্যাংকের এই দুর্নীতি আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং সুশাসনের অভাবকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে। এখন সময় এসেছে এই খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।