বৃহস্পতিবার, ৩ অক্টোবর ২০২৪, ১৮ আশ্বিন ১৪৩১

সাগর-রুনি খুন: ১২ বছরেও ন্যায়বিচার পাওয়া যায়নি কেন?

প্রকাশিতঃ ১ অক্টোবর ২০২৪ | ১১:৩৯ পূর্বাহ্ন


একুশে প্রতিবেদক : ২০১২ সালে নিহত সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যা মামলার তদন্তে এক যুগ ধরেও কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি না হওয়ায় উচ্চ আদালত একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্স গঠনের নির্দেশ দিয়েছে।

এই মামলার তদন্তের দায়িত্ব প্রথমে থানা পুলিশ, পরে গোয়েন্দা পুলিশ এবং অবশেষে র‌্যাবের উপর ন্যস্ত হলেও ১৪৮ মাসে আদালতের কাছ থেকে ১১১ বার সময় নিয়েও র‌্যাব কোনো সঠিক তথ্য উদঘাটন করতে ব্যর্থ হয়েছে।

র‌্যাবের মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মুনীম ফেরদৌস বিচারধীন বিষয় বলে এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানালেও, সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন তদন্ত ঠিক পথে এগোতে পারেনি।

কয়েক মাস আগে সাগর-রুনির বাড়িতে দুজন অজ্ঞাত ব্যক্তির ডিএনএ পাওয়া গেলেও তাদের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। এখন উচ্চ আদালতের নির্দেশে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ছয় মাসের মধ্যে এই টাস্কফোর্স গঠন করে তদন্ত সম্পন্ন করতে হবে।

এই ঘটনায় জনমনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। সাংবাদিক সমাজসহ বিভিন্ন মহল এই মামলার একটি দ্রুত ও ন্যায্য বিচারের দাবি জানিয়ে আসছে।

তদন্তে বাধা, বিপত্তি ও অন্ধকার

সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্তে নানা বাধা ও বিপত্তির মুখোমুখি হয়েছে তদন্তকারী সংস্থা। এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তে র‌্যাব দীর্ঘদিন ধরে কাজ করলেও এখনো কোনো সঠিক ফলাফল পাওয়া যায়নি।

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস জানিয়েছেন, তদন্ত চলাকালীন কোনো তথ্য প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তবে তদন্তের সঙ্গে যুক্ত একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য পাওয়া গেলেও পরবর্তীতে নানা বাধার কারণে তদন্ত সঠিক পথে এগোতে পারেনি। তিনি আরও জানান যে, সাংবাদিক মহল থেকেও তদন্তে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্তে গ্রেফতার ব্যক্তিদের পাশাপাশি অনেকের ডিএনএ নমুনা পরীক্ষা করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া ডিএনএ নমুনা যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হলেও কোনো সঠিক ফলাফল পাওয়া যায়নি। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, ঘটনাস্থলে দুজন ব্যক্তির ডিএনএ পাওয়া গেছে যাদের সঙ্গে অন্য কারও নমুনা মিলছে না।

সাংবাদিক সমাজ এবং জনগণ এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অনেকে আশা করছেন, এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচিত হবে।

এক নৃশংস হত্যাকাণ্ডের চিত্র

২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি, ঢাকার পূর্ব রাজাবাজারে সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারওয়ার ও মেহেরুন রুনি নিজেদের ভাড়া বাসায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই ঘটনাটি দেশবাসীর মনে গভীর চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল।

পাঁচ বছরের ছেলে মেঘকে নিয়ে রাতে বাড়ি ফেরার পর সাগর ও রুনিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সকালে তাদের রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। সাগরের দেহে ধারাল অস্ত্রের কয়েক ডজন আঘাতের চিহ্ন ছিল, যা ইঙ্গিত দেয় যে তাকে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়েছিল। রুনির শরীরেও ধারাল অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন ছিল।

তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সাগরকে দীর্ঘ সময় ধরে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। তার শরীরে পাওয়া ২৮টি আঘাতের চিহ্ন ইঙ্গিত করে যে তিনি চরম প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন। খুনিরা অপেশাদার ছিল এবং তারা হত্যার আগে সাগরকে হাত-পা ও মুখ বেঁধে রেখেছিল।

ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকরা মনে করেন, খুনিরা সাগর ও রুনিকে পূর্ব পরিচিত ছিল। পুলিশ কর্মকর্তারাও এই সন্দেহ ব্যক্ত করেছেন।

এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত এখনো অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। সাংবাদিক সমাজ এবং জনগণ এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে।

তদন্তে দীর্ঘ বিলম্ব ও নানা জটিলতা

সাগর সারওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্তে গত এক দশক ধরে নানা জটিলতা ও বিলম্বের মুখোমুখি হয়েছে। এই ঘটনার পরপরই তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তারের আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু খুনি চিহ্নিত হওয়ার আগেই তাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছাড়তে হয়েছিল।

ঘটনার এক সপ্তাহ পর তৎকালীন পুলিশ প্রধান হাসান মাহমুদ খন্দকার তদন্তে ‘প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি’ হওয়ার খবর দিলেও তার কোনো স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব শুরুতে শেরেবাংলা নগর থানার তৎকালীন এসআই জহুরুল ইসলামের কাছে ছিল। পরে ডিবির পরিদর্শক রবিউল আলমের কাছে হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু ডিবি ৬২ দিনেও কোনো কূল-কিনারা করতে না পারায় আদালতের নির্দেশে মামলাটি র‌্যাবের কাছে হস্তান্তর করা হয়। র‌্যাব গত ১২ বছর ধরে এই মামলাটি তদন্ত করে যাচ্ছে।

সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্তে এতদিনেও কোনো সঠিক ফলাফল না পাওয়া জনগণের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করেছে। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে কারা ছিল এবং কেন এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল, তা এখনো একটি রহস্য।

তদন্ত নিয়ে সমালোচনা

সাগর সারওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্তে গত এক দশক ধরে নানা জটিলতা ও সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে। এই ঘটনার পরপরই তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে খুনিদের দ্রুত গ্রেপ্তারের আশ্বাস দেওয়া হলেও বাস্তবে তা সম্ভব হয়নি।

প্রথমদিকে পুলিশ কর্মকর্তারা পেশাগত বিরোধ, সম্পত্তি ও ব্যক্তিগত শত্রুতাকে হত্যাকাণ্ডের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছিল। পরবর্তীতে ডাকাতি-চুরি সহ ছয়টি কারণকে সামনে রেখে তদন্ত চালানো হয়েছিল। এমনকি একটি ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন, স্বর্ণালঙ্কার ও ১১শ ইউরো খোয়া যাওয়ার বিষয়টিও তদন্তের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল।

পরে একদল গ্রিল কাটা চোরকে ধরে তাদেরকেই এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী করে সরকার। তবে পরবর্তীতে এই দাবির কোনো বৈধতা পাওয়া যায়নি। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা নিজেদের নির্দোষ বলে দাবি করেছিল এবং তাদের মধ্যে অনেকেই নারায়ণ চন্দ্র দত্ত হত্যাকাণ্ডের আসামি ছিল।

সাংবাদিক দম্পতি খুনের তদন্ত শেষ না হওয়ায় সরকারের সমালোচনা হয়েছিল। তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক একবার বলেছিলেন, সময় বেশি লাগলেও সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তা দিতে হবে।

এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তে এতদিনেও কোনো সঠিক ফলাফল না পাওয়া জনগণের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করেছে। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে কারা ছিল এবং কেন এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল, তা এখনো একটি রহস্য।