
শরীফুল রুকন : দেশে বর্তমানে কোন কোন ওষুধ নিষিদ্ধ; কখন এবং কেন নিষিদ্ধ করা হয়েছে সে সম্পর্কিত তথ্য জানতে চেয়ে এই প্রতিবেদক তথ্য অধিকার আইনের আওতায় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে আরটিআই আবেদন করেন গত ৫ জুন। একই আবেদন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়েও পাঠানো হয় একই দিনে।
পরে প্রতিবেদককে তথ্যগুলো দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে গত ২৭ জুন ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে চিঠি দেওয়া হয় মন্ত্রণালয় থেকে। চিঠিতে স্বাক্ষর করেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব মো. আবু সুফিয়ান।
কিন্তু গত ৯ জুলাই ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক ও প্রতিষ্ঠানটির তথ্য প্রদানের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম এই প্রতিবেদককে চিঠি দিয়ে জানান, ‘তথ্য প্রাপ্তির জন্য প্রয়োজনীয় ফি পরিশোধ করা হয়নি এবং তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ এর ৪ এর (ঘ), (ঙ) ও (ছ) ধারা অনুযায়ী তথ্যগুলো দেওয়া সম্ভব নয়।
যদিও তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ এর ৪ এর (ঘ), (ঙ) বা (ছ) ধারা বলে কিছু নেই। আর আইনের ৯ (৬) ধারা অনুযায়ী তথ্যের জন্য কত টাকা দিতে হবে, সেটা আগে প্রতিবেদককে জানানোই হয়নি। তাই তথ্য না দেওয়ার জন্য ‘ফি জমা না দেওয়ার অজুহাত দেখানো’ ঠিক হয়নি- এই বিষয়টি উল্লেখ করে প্রতিবেদক ২৮ জুলাই ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে আপিল করেন।
আপিলের পর নড়েচড়ে বসে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। এক পর্যায়ে গত ১৮ আগস্ট ‘বাতিল ওষুধের তালিকা’ নামে একটি তালিকা দেওয়া হয় অধিদপ্তর থেকে। কিন্তু এই তালিকায় থাকা ওষুধগুলো কবে বাতিল করা হয়েছিল, সেই তারিখ দেওয়া নেই; শুধু ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কমিটির কততম সভায় বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছিল, সেটাই উল্লেখ আছে। সেই সুপারিশ আদৌ বাস্তবায়ন বা কার্যকর করা হয়েছে কি না, তাও বলা হয়নি।
এই তালিকায় থাকা ৪১টি ওষুধ মানুষের ও ৯টি ওষুধ পশুর চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়; এর মধ্যে ২০টি ওষুধ একাধিক ওষুধের সমন্বয়ে (কম্বিনেশন ওষুধ) তৈরি এবং একই ওষুধ বিভিন্ন আকারে (যেমন ২ মিলিগ্রাম, ৪ মিলিগ্রাম) অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই তালিকায় থাকা দুটি ওষুধের রেজিস্ট্রেশন এখনও বাতিল করা হয়নি। তালিকায় থাকা কিছু ওষুধ তৈরির কাঁচামাল আমদানির অনুমতি এখনও দিচ্ছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। এই তথ্যগুলো একুশে পত্রিকার এই ধারাবাহিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের প্রথম পর্বে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে গতকাল।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর থেকে ‘বাতিল ওষুধের তালিকা’ নামে যেটা দেওয়া হয়েছে, তাতে ওষুধগুলো কবে বাতিল হয়েছে সেই তারিখের বদলে শুধু ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কমিটির (ডিসিসি) কোন সভায় সেগুলো বাতিল করার সুপারিশ করা হয়েছে, সেটা উল্লেখ আছে। এই তালিকায় থাকা ৫০টি ওষুধ ডিসিসির ২০০৫ সালের ৩ জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ২১ জুনের মধ্যে অনুষ্ঠিত ১১টি সভায় বাতিল করার সুপারিশ করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
কিসের ভিত্তিতে ওই ৫০টি ওষুধ বাতিল করার সুপারিশ করা হয়েছে- তথ্য অধিকার আইনের আওতায় করা আবেদনে জনতে চাওয়া হলেও সে তথ্য জানায়নি ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। বাতিলের সুপারিশগুলো কোন কোন তারিখে বাস্তবায়ন হয়েছে বা সেই সুপারিশগুলো আদৌ কার্যকর করা হয়েছে কি না, তাও জানানো হয়নি।
জানা গেছে, নিয়ম অনুযায়ী ডিসিসি সভায় বাতিলের সুপারিশ করার পর এই বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অফিস আদেশ জারি করে ওই ওষুধগুলো বাতিল করার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। তখন থেকেই ক্ষতিকর ওষুধগুলো বাতিল বা নিষিদ্ধ হয়ে যায়।
এছাড়া ডিসিসির এই ১১টি সভার বাইরে ডিসিসির আরও অন্তত ২৪৩টি সভা হয়েছে, যেগুলোর সুপারিশ অনুযায়ী কোনো ওষুধ নিষিদ্ধ বা বাতিল হয়েছে কি না, সেই তথ্য ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর এখনও পর্যন্ত দেয়নি।
গত ১৮ আগস্ট প্রতিবেদক যখন অধিদপ্তরের তথ্য প্রদানের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা ও পরিচালক মো. শফিকুল ইসলামের কাছে এ বিষয়ে জানতে চান, তখন তিনি ঢাকার মহাখালীতে নিজের অফিস কক্ষে প্রতিবেদককে জোর করে মোবাইল ফোন বন্ধ করিয়ে দেন। এরপর বলেন, ‘আমার কাছে যেসব তথ্য আছে, তা দিয়েছি। আর কোনো তথ্য জানতে চাইলে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করুন।’
প্রতিবেদক তাকে মনে করিয়ে দেন যে, ‘তথ্য অধিকার আইনেই আবেদন করা হয়েছিল, কিন্তু বাতিল বা নিষিদ্ধ ওষুধের পূর্ণাঙ্গ তালিকা কেউ দেয়নি।’ তখন পরিচালক আর কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
এ প্রতিবেদক আগে তথ্য অধিকার আইনে নিষিদ্ধ ওষুধের তথ্য চাইলে ঔষধ পরিদর্শক রাজীব দাস তথ্য খুঁজে বের করার দায়িত্ব পান। পরিচালক মো. শফিকুল ইসলামের নির্দেশেই তিনি তথ্য প্রদান করেন। রাজীব দাস গত ১৮ আগস্ট ঢাকার মহাখালীতে নিজের কার্যালয়ে বলেন, ‘আমরা যথাসম্ভব তথ্য দিয়েছি, কিন্তু সব তথ্য আমাদের কাছে নেই।’
রাজীব দাস বলেন, ‘আপনি ১৯৭২ সাল থেকে সব নিষিদ্ধ ওষুধের তালিকা চেয়েছিলেন, কিন্তু এত পুরোনো তথ্য কারও কাছে নেই। তবে কিছু তথ্য দিয়ে আপনাকে সাহায্য করতে পারব। ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কমিটির ২৩০তম সভা থেকে ২৫৪তম সভা পর্যন্ত বাতিলের সুপারিশ করা ওষুধের তালিকা দিতে পেরেছি। এর আগের তথ্য নেই।’ বাতিলের সুপারিশ করা ওষুধগুলো বাতিল বলে ধরে নিতে বলেন তিনি।
ঔষধ প্রশাসন কুমিল্লা জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সালমা সিদ্দিকাও একুশে পত্রিকাকে জানিয়েছেন, তাদের কার্যালয়ে নিষিদ্ধ অথবা বাতিল ওষুধের সম্পূর্ণ তালিকা থাকে না। তবে ওষুধ বাতিল বা নিষিদ্ধের বিষয়ে সময়ে সময়ে যে অফিস আদেশ জারি করা হয়, সেগুলি তারা সংরক্ষণ করেন এবং সে অনুযায়ী মাঠ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
গত ২২ সেপ্টেম্বর ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল কাজী মো. রশীদ-উন-নবী (কয়েকদিন আগে বদলি হয়েছেন) একুশে পত্রিকার কাছে স্বীকার করেছেন, নিষিদ্ধ অথবা বাতিল ওষুধের পূর্ণাঙ্গ তালিকা নেই। তিনি বলেন, ‘তবে যেসব ওষুধের অনুমতি আছে, সেগুলোর একটা তালিকা আছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক আ ব ম ফারুক মনে করেন, স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ অথবা বাতিল ওষুধের পূর্ণাঙ্গ তালিকা না থাকলে সমস্যা হতে পারে। কোন ওষুধ নিষিদ্ধ বা বাতিল, এটা স্পষ্ট করে বলা উচিত, যাতে সবাই বুঝতে পারে। নিষিদ্ধ ও বাতিল ওষুধের একটি সুনির্দিষ্ট তালিকা না থাকলে বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে এবং আইনি জটিলতা বাড়তে পারে।
গড়িমসি নাকি তথ্য গায়েব!

তথ্য অধিকার আইনে গত ৫ জুন ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কাছে আরও কিছু তথ্য চেয়েছিলেন এ প্রতিবেদক। তিনি ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত অনুষ্ঠিত অ্যাডভান্স ড্রাগ রিঅ্যাকশন এডভাইজরি কমিটির (এডিআরএসি) প্রতিটি সভার কার্যবিবরণীর কপি চেয়েছিলেন। এই প্রেক্ষিতে অধিদপ্তর এডিআরএসি-এর ১০ম সভার কার্যবিবরণী ছাড়া ৯ম থেকে সর্বশেষ ১৭তম সভার কার্যবিবরণী প্রদান করেছে। ৯ম সভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৮ সালের ২৮ নভেম্বর। সে হিসেবে ১০ম সভার কার্যবিবরণী ও ২০১৮ সালের ২৮ নভেম্বরের আগের বাকি সভাগুলোর কার্যবিবরণী ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর দেয়নি।
এছাড়া ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত অনুষ্ঠিত এডিআরএম সেলের প্রতিটি মাসিক সভার কার্যবিবরণীর কপিও চেয়েছিলেন এ প্রতিবেদক। কিন্তু দেওয়া হয়েছে ২০১৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত কিছু মাসের সভার কার্যবিবরণী। অন্যগুলো দেওয়া হয়নি।
২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত এডিআরএম সেলের পক্ষ থেকে যেসব প্রতিবেদন এডিআরএসি-এর সভায় উপস্থাপন করা হয়েছে, সে প্রতিবেদনগুলোর কপিও চেয়েছিলেন এ প্রতিবেদক। কিন্তু এগুলোর একটিও দেওয়া হয়নি; কোনো কারণও জানানো হয়নি।
যদিও তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী দেশের যেকোনো নাগরিকের চাহিদামতো তথ্য প্রদান করতে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ওই আইনের ৪ ধারায় বলা আছে, ‘এই আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে, কর্তৃপক্ষের নিকট হইতে প্রত্যেক নাগরিকের তথ্য লাভের অধিকার থাকিবে এবং কোন নাগরিকের অনুরোধের প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাহাকে তথ্য সরবরাহ করিতে বাধ্য থাকিবে৷’ একই আইনের ৮(১) ধারায় উল্লেখ আছে, ‘কোন ব্যক্তি এই আইনের অধীন তথ্য প্রাপ্তির জন্য সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নিকট তথ্য চাহিয়া লিখিতভাবে বা ইলেক্ট্রনিক মাধ্যম বা ই-মেইলে অনুরোধ করিতে পারিবেন৷’
নিষিদ্ধ ওষুধের সঠিক তালিকা ও সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রদানের জন্য গত ৭ অক্টোবর ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর একটি অনুরোধপত্রও দেওয়া হয়। পাশাপাশি তথ্য অধিকার আইনে ৫ জুনের আবেদনের প্রেক্ষিতে যথাযথ তথ্য না পাওয়ায় গত ১৭ অক্টোবর তথ্য কমিশনেও অভিযোগ করেন এই প্রতিবেদক। তবে ৫ আগস্টের পর দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তথ্য কমিশনের কাজে স্থবিরতা বিরাজ করছে। প্রধান তথ্য কমিশনার দায়িত্বে না থাকায় এ বিষয়ে প্রতিকার পাওয়া সময়সাপেক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ঔষধ পরিদর্শক রাজীব দাস বলেন, ‘মহাপরিচালক স্যার বরাবর করা আপনার ৭ অক্টোবরের অনুরোধপত্রটি নিয়েও আমরা কাজ করছি। কিন্তু আপনি যেভাবে নিষিদ্ধ, বাতিল ওষুধের পূর্ণাঙ্গ তালিকা চাইছেন, সেটা আমরা আপনাকে দিতে পারছি না। দেওয়া সম্ভবও হবে না। আমি সব শাখাতেই খোঁজ নিয়ে দেখেছি, এসব তথ্য কেউই দিতে পারছে না।’
সরকারি নথিপত্র দীর্ঘমেয়াদে সংরক্ষণের বিধান আছে জানানো হলে তিনি বলেন, ‘সরকারি নথিপত্র ৬ বছরের বেশি হলে স্টোররুমে ফেলে রাখে; সেখান থেকে দেখা যায় পরে কেজি দরে বিক্রি করে দেয় ফেরিওয়ালাদের কাছে।’
৬ বছরের তথ্যও তো দিতে পারেননি বলা হলে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, মিসিং আছে। ফাইলগুলো যেখানে থাকার কথা, সেখানে নাই। নিয়ম হলো, নথিপত্র যদি কেউ ধ্বংস করে, কী নথি, কত তারিখে ধ্বংস করেছে, কীভাবে ধ্বংস করেছে, কার উপস্থিতিতে- এগুলোর রেকর্ড রাখতে হয়, এটা নিয়ম। কিন্তু এটা সব জায়গায় অনুসরণ করা হয় না।’
ওষুধ সংক্রান্ত নথিপত্র দীর্ঘমেয়াদে সংরক্ষণ করা উচিত কি না- প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আসলে বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধার লোক তো কেউ নাই। এই ধরনের তথ্য দীর্ঘমেয়াদে অবশ্যই সংরক্ষণে থাকা উচিত। আপনার চাওয়া তথ্যগুলো না পেয়ে আজকেও (২১ অক্টোবর) বড় স্যারদের জানালাম, স্যাররাও একরকম অসহায়ত্ব প্রকাশ করলেন।’
ভারতে নিষিদ্ধ ৬১৪ ওষুধ
প্রতিবেশী দেশ ভারতে ওষুধের নিষিদ্ধকরণ নিয়ে কঠোর নীতিমালা দেখা যায়। তাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সেন্ট্রাল ড্রাগস স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানাইজেশনের (সিডিএসসিও) ওয়েবসাইটে ১৯৮৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত নিষিদ্ধ ৪৪৪টি জেনেরিক ওষুধের তালিকা রয়েছে। এর মধ্যে ৩৪৩টি ওষুধই নিষিদ্ধ হয় ২০১৬ সালে। ২০২৩ সালেও তারা জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে ১৪টি জেনেরিক ওষুধ নিষিদ্ধ করেছে। এমনকি, গত ২২ আগস্টও ভারতে ১৫৬টি জেনেরিক ওষুধ নিষিদ্ধ করা হয়েছে বলে দেশটির গণমাধ্যমগুলো খবর দিয়েছে। সবমিলে ভারতে ৬১৪টি জেনেরিক ওষুধ নিষিদ্ধ হওয়ার তথ্য পাওয়া যায় অনলাইনে খোঁজাখুঁজি করে।
অন্যদিকে বাংলাদেশে ওষুধ নিষিদ্ধের খবর খুব একটা শোনা যায় না। এ প্রতিবেদককে মাত্র ৫০টি ‘বাতিলের সুপারিশ করা’ জেনেরিক ওষুধের তালিকা দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর; সেখানেও মিলেছে নানা অসংগতি।
- ভারতে নিষিদ্ধ ওষুধের সংখ্যা ৬১৪ (নীল রঙ)। বাংলাদেশে বাতিল ওষুধের সংখ্যা ৫০ (কমলা রঙ)
তবে ‘দ্য ড্রাগ অ্যাক্ট অ্যান্ড রুলস ১৯৪০ থেকে ২০০৬’ শীর্ষক বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৮২ সালে দেশে ঔষধ (নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ জারি করে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির ১৭০৭টি ব্র্যান্ডেড ওষুধ (জেনেরিক ওষুধ নয়) নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি ধ্বংস করার নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই কোম্পানিগুলোর মধ্যে স্কয়ারসহ ৩টি ছাড়া বাকিগুলোর অস্তিত্ব এখন দেশে নেই।
বাংলাদেশ ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেখা যায়, ২২ অক্টোবর পর্যন্ত দেশে ৪ হাজার ২০৯টি জেনেরিকের ৩৬ হাজার ২৯টি অ্যালোপেথিক ওষুধের রেজিস্ট্রেশন বলবৎ আছে। এর মধ্যে ৬ হাজার ৯৫৬টি কম্বিনেশন ওষুধ, যা বিভিন্ন কোম্পানি বিভিন্ন নামে বাজারজাত করছে।
ভারতে নতুন এবং অনুমোদিত অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের বিস্তারিত তালিকা নিয়মিত আপডেট করা হয় সেন্ট্রাল ড্রাগস স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন (সিডিএসসিও)-এর ওয়েবসাইটে। গত ২২ অক্টোবর ওয়েবসাইটটির তথ্য অনুযায়ী, ভারতে ৩৭২৫টি জেনেরিক ওষুধের রেজিস্ট্রেশন বলবৎ রয়েছে। এর মধ্যে ৯১৩টি কম্বিনেশন ওষুধ।
দুই দেশের উপরোক্ত তথ্যের তুলনা করলে, ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে ওষুধ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে উদাসীনতা রয়েছে কি না সেই প্রশ্ন উঠে। দেশে একদিকে বিপজ্জনক ওষুধ নিষিদ্ধ করতে তো দেখাই যাচ্ছে না, অন্যদিকে নিষিদ্ধ ওষুধের তালিকা তৈরি বা প্রচার করাও হচ্ছে না; উল্টো গোপন করা হচ্ছে! এর কারণ কী?
জনতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ একুশে পত্রিকাকে বলেন, ক্ষতিকর ওষুধ নিষিদ্ধ বা বাতিল করার ক্ষেত্রে ওষুধ কোম্পানিগুলোর চাপ মোকাবিলার শক্তি ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের নাই। তাদেরকে যথেষ্ট শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা হয়নি। যদি গড়ে তোলা হতো তারা চাপ মোকাবিলা করতে পারতো। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে যারা চাকরি করবেন, তাদের ট্রেনিং, ক্যাপাসিটি, নীতি নৈতিকতা, এই বিষয়গুলোতে জোর দিতে হবে।’
‘যেহেতু ওষুধের সাথে মানুষের জীবন জড়িত, বিপদজনক ওষুধ, ভেজাল ওষুধ, নষ্ট ওষুধ, নিম্নমানের ওষুধ- এগুলো যদি মানুষের হাতে যায়, তাহলে লক্ষ লক্ষ মানুষের ক্ষতি হবে। তাই ঔষধ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের যেকোনো প্রকার গাফিলতি, দুর্নীতি- এগুলো সহ্য করা উচিত না।’
অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ আরও বলেন, ‘ঔষধ প্রশাসন যথেষ্ট শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান না। এটাকে শক্তিশালী করতে গেলে এটাকে শক্তিশালী কমিশনে রূপান্তর করতে হবে। তাদের এমন কাঠামো গড়ে তুলতে হবে, যাতে ওষুধ কোম্পানির চাপ সহ্য করতে পারে।’
গত ২২ সেপ্টেম্বর ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল কাজী মো. রশীদ-উন-নবী (এ প্রতিবেদন প্রকাশের কয়েকদিন আগে তিনি বদলি হয়েছেন) বলেন, ‘বর্তমানে ঔষধ প্রশাসনে রাজনীতিবিদদের চাপ বা প্রভাব নেই এবং আমরা সংস্কারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।’
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের নবনিযুক্ত মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. শামীম হায়দার একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি মাত্র এসেছি। ঔষধ প্রশাসনকে শক্তিশালী করতে যা যা করা লাগবে, জনস্বার্থে আমরা অবশ্যই করবো।’
তৃতীয় পর্ব আগামীকাল : ঝুঁকি বাড়াচ্ছে এডিআর রিপোর্টে অবহেলা

