এস এম আক্কাছ, ফটিকছড়ি (চট্টগ্রাম) : অবিশ্রান্ত পরিশ্রম আর অদম্য ইচ্ছাশক্তির বলে অজঁপাড়া গ্রামের প্রান্তিক কৃষকদের নিয়ে যাত্রা করা এক সমবায় সমিতি আজ জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হয়ে দেশের শ্রেষ্ঠত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে! হ্যাঁ, বলছি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ‘হারুয়ালছড়ি খাল পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি’র কথা।
গ্রামের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা এইসব কৃষকদের জীবনে আশার আলো জ্বালিয়ে, সার্বিক গ্রাম উন্নয়নের মহৎ কাজে অসামান্য অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ এই গৌরবময় পুরস্কার তাদের ঝুলিতে এসেছে।
শনিবার (২ নভেম্বর), ৫৩তম জাতীয় সমবায় দিবসের ঐতিহাসিক মুহূর্তে, অধিদপ্তরের মাল্টিপারপাস সম্মেলন কক্ষে উপস্থিত সকলের প্রাণ আনন্দে ভরে উঠেছিল যখন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্ঠা এ এফ হাসান আরিফ সমিতির সভাপতিকে সম্মাননা ক্রেস্ট, সনদ ও এক লক্ষ টাকার নগদ অর্থ তুলে দেন।
‘সমবায়ে গড়ব দেশ, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ’- এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে জাতীয় সমবায় দিবস পালন করে সরকার। মোট ১০ ক্যাটাগরিতে জাতীয়ভাবে এ পুরস্কার দেয় সমবায় মন্ত্রণালয়। তার একটি ক্যাটাগরি ‘কৃষিতে সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন’। সেখানে হারুয়ালছড়ি পানি ব্যবস্থাপনা সমিতি উপজেলা, জেলা, বিভাগ এবং জাতীয়ভাবে ‘সেরা’ মর্যাদার আসন লাভ করে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৫ জন কৃষক সদস্য নিয়ে যাত্রা করা উপজেলার হারুয়ালছড়ি খাল পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। সদস্যরা মিলে শুরুতে স্থানীয় একটি খালে বাঁধ দিয়ে পানি জমিয়ে সেখানে কৃষকেরা তাদের পতিত জমি চাষাবাদের আওতায় আনেন। মাত্র কয়েক শতক জমি নিয়ে প্রথমে চাষাবাদ শুরু হয়।
বর্তমানে আড়াই হাজার কৃষকের চাষযোগ্য জমির পরিমান ৫০০ একর। সেখানে কৃষকেরা প্রতিবছর ৪০ শতাংশে সেচ কর হিসেবে সমিতিতে ৫০০ টাকা জমা দেন। সমিতির ঋণ গ্রহীতা প্রায় দুই হাজার এবং বর্তমান মূলধন ১৪ কোটি টাকা। এছাড়া রয়েছে ৯০ লাখ টাকার শেয়ার মূলধন এবং ৬ কোটি টাকার বেশি ঋণের স্থিতি। গত কয়েক বছরে সমিতির অর্থে স্থানীয় দু:স্থদের সিএনজি ও মোটরসাইকেল কিনতে দেওয়া হয় ২০০ চালককে ঋণ। তারা কিস্তিতে এসব টাকা পরিশোধ করেছেন। এছাড়া কৃষকদের ধান উৎপাদন, মৎস্য, পোল্ট্রি, সেলাই মেশিন, গবাদি পশু পালনের জন্য সমিতির সদস্যদের দারিদ্রতা দূর করতে কাজ চলমান। বর্তমানে ১০ শতক জমির উপর রয়েছে নিজস্ব ভবন। আরো ২০ শতকে পোল্ট্রি ও গবাদি পশু পালনে খামারের কাজ প্রক্রিয়াধীন।
সমিতি পরিচালনায় রয়েছে ১১ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি। যাঁর সভাপতি হলেন স্থানীয় হারুয়ালছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. ইকবাল হোসেন চৌধুরী এবং সম্পাদক মো. সেলিম উল্লাহ চৌধুরী।
সভাপতি মো. ইকবাল হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘মহাজনী ঋণ থেকে বাঁচাতে স্থানীয় চাষিদের নিয়ে সমিতি গঠন করি। শুরুতে সদস্যদের কাছ থেকে ৫০ টাকা করে জমা নেওয়া হত। আস্তে আস্তে সমিতির সদস্য বাড়তে থাকায় মুলধনের পরিমাণও বাড়ে। এভাবে পুঁজি গঠন করে সদস্যদের ঋণ দেওয়া হতো। যা দিয়ে ধান ও মাছ চাষ শুরু করেন কৃষকরা। এসব বিক্রি করে সুবিধা অনুযায়ী ঋণের টাকা পরিশোধের সুযোগ দেওয়া হয়। এই টাকা একটি বড় শক্তিতে পরিণত হয়। বতর্মানে উক্ত সমিতি এলাকার জন্য একটি মডেল।’
সমিতির সুবিধাভোগী সদস্য সিএনজি অটোরিকশা চালক মো. সরোয়ার জানান, ‘আমার পক্ষে কখনো নতুন সিএনজি কেনার সামর্থ ছিল না। এই সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে একটি সিএনজি কিনি। পরে সেই টাকা পরিশোধ করে নিরাপদ এবং সুখী জীবন-যাপন নিশ্চিত করেছি। এই সমিতির মাধ্যমে অসংখ্য মানুষের কল্যাণ হয়েছে।’
সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. সেলিম উল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘শুরু থেকেই উদ্দেশ্য ছিল সমবায়ের ভিত্তিতে কৃষিভিত্তিক গ্রাম উন্নয়ন সাধন। পাশাপাশি গরীব ও অসহায়দের বিভিন্নভাবে সহায়তা দেওয়া। সমতার ভিত্তিতে সদস্যদের যে কোন সমস্যা-সমাধানের ব্যবস্থা আমরা করেছি।’
ফটিকছড়ি উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা এম এ শহিদ ভূঁঞা বলেন, ‘কৃষিভিত্তিক সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমবায়ে অবদান রাখায় এ সমিতি এবার জাতীয় পুরস্কার পেয়ে দেশ সেরা হয়েছে। এতে আমরা গর্বিত। আশা করছি তাদের এ কল্যাণময় ধারা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘এটি অত্যন্ত আনন্দ এবং গৌরবের। গ্রামপর্যায়ে এই অবদান চাট্টিখানি কথা নয়। তিলে তিলে তাঁরা এটিকে গড়ে তুলেছেন। অবশ্যই তাদের স্যালুট।’