বুধবার, ৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

ওষুধ কোম্পানিগুলোর লোভের শেষ কোথায়?

প্রকাশিতঃ ২৫ নভেম্বর ২০২৪ | ৮:৫৪ পূর্বাহ্ন


নজরুল কবির দীপু : বর্তমান সময়ে ওষুধের লাগামহীন দাম সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় গভীর প্রভাব ফেলছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে সঙ্গে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি অসুস্থ ও অসহায় মানুষকে এক অসহনীয় অবস্থার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। জীবন বাঁচানোর জন্য যেখানে প্রয়োজনীয় ওষুধ সুলভ হওয়া উচিত, সেখানে দ্বিগুণ-তিনগুণ দাম দিয়ে ওষুধ কিনতে গিয়ে অনেকে আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। এর সঙ্গে রয়েছে নকল ওষুধের প্রকোপ। এমন অবস্থায় একটি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা না গেলে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখা কঠিন হবে।

দেশীয় ওষুধ উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও, ওষুধের দাম এখন সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। দেশে উৎপাদিত ৯৭ শতাংশ ওষুধ দেশের প্রয়োজন মেটায়, এবং মাত্র ২ শতাংশ ওষুধ আমদানি করা হয়। তবুও দেশীয় ওষুধের দাম লাগামহীনভাবে বাড়ছে। বর্তমানে দেশে ৩১০টি নিবন্ধিত ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানি রয়েছে। এর মধ্যে ৫৮টি কোম্পানি বিশ্বের ১৫৭টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করে। রপ্তানি খাতে এ সাফল্য সত্ত্বেও, দেশের বাজারে ওষুধের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এক বড় সংকট তৈরি করছে।

২০২০ সালের পর থেকে গত চার বছরে প্রায় ৯০ শতাংশ দেশীয় ও আমদানিকৃত ওষুধের দাম বেড়েছে। ফার্মাসিস্ট এবং ভোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কাঁচামাল আমদানির খরচ, ডলার এবং জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাত দেখিয়ে ব্যবসায়ীরা ওষুধের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। রোগীরা বাধ্য হয়ে এই অতিরিক্ত মূল্য পরিশোধ করছে। এতে চিকিৎসা খরচ বাড়ছে এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে উঠছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, চিকিৎসা ব্যয়ের প্রায় ৫৪ শতাংশ ওষুধের পেছনে ব্যয় হয়। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের ক্ষেত্রে এই খরচ প্রায় ২৫ শতাংশ। অথচ ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো ইচ্ছেমতো ওষুধের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, সম্প্রতি স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের টেরাক্স ট্যাবলেটের দাম এক মাসের ব্যবধানে ১২ টাকা থেকে বেড়ে ২০ টাকা হয়েছে। ৫০ পিচের একটি বক্সের দাম ৬০০ টাকা থেকে এক হাজার টাকায় পৌঁছেছে। এই ধরনের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি রোগীদের উপর আর্থিক চাপ আরও বাড়িয়ে তুলছে।

দ্রুত মূল্যবৃদ্ধির অন্য উদাহরণগুলোও চিন্তার কারণ। যেমন, এসিআইয়ের টেট্রাসল সল্যুসনের দাম ৬৮ টাকা থেকে বেড়ে ১২৫ টাকা হয়েছে, যা প্রায় ৬৭ শতাংশ বৃদ্ধির সমান। ইনসেপ্টার উইন্ডেল গ্লাস রেস্পিরেটর সল্যুসনের দাম ২০ টাকা থেকে ২৫ টাকা হয়েছে। এভাবে প্রায় সব ধরনের ওষুধের দামই ধাপে ধাপে বেড়ে চলেছে।

সরকারি নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি রোধে এই সংস্থার দায়িত্ব থাকলেও, বাস্তবে এর কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। বরং অভিযোগ উঠেছে যে, কিছু কোম্পানি ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের যোগসাজশে মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে ৭ থেকে ১৪০ শতাংশ পর্যন্ত ওষুধের দাম বাড়িয়েছে। এমনকি হাইকোর্টের নির্দেশনার পরও এই সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি।

ওষুধের দাম বৃদ্ধির ফলে দেশের জনস্বাস্থ্যের উপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদদের মতে, চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে প্রতিবছর প্রায় ৬১ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে। যা মোট জনসংখ্যার ৩.৭ শতাংশ।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) একটি গবেষণায় দেখা গেছে, একটি পরিবারের একজন সদস্য হাসপাতালে ভর্তি হলে গড়ে প্রায় ৫৫ হাজার টাকা ব্যয় করতে হয়। এর ২৫ শতাংশ ওষুধের পেছনে ব্যয় হয়। আর যারা হাসপাতালে ভর্তি হন না, তাদের চিকিৎসা ব্যয়ের ৫৪ শতাংশই ওষুধের পেছনে ব্যয় হয়। এই খরচ সামলাতে গিয়ে অনেক পরিবার চরম আর্থিক সংকটে পড়ে।

এদিকে দেশে ওষুধ উৎপাদনে সাফল্যের পরও স্থানীয় বাজারে ওষুধের দাম বৃদ্ধির প্রবণতা প্রশ্ন তুলছে। ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো বিদেশে ওষুধ রপ্তানি করে বিপুল মুনাফা অর্জন করছে। অথচ তারা দেশের বাজারে বিভিন্ন অজুহাতে ওষুধের দাম বাড়াচ্ছে। রপ্তানি বাড়ানোর অজুহাতে স্থানীয় রোগীদের কষ্টের মুখে ঠেলে দেওয়া অনৈতিক।

ওষুধের এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি রোধে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। ১৯৮২ সালের ওষুধ নীতির কঠোর প্রয়োগ এই সংকট সমাধানে ভূমিকা রাখতে পারে।

জনসাধারণের ওষুধের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে এবং সাশ্রয়ী মূল্যে ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করতে সরকারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।

প্রথমত, ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণে একটি শক্তিশালী তদারকি ব্যবস্থা চালু করা অত্যাবশ্যক। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে ওষুধ কোম্পানিগুলোর মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়া, উৎপাদন খরচ এবং মুনাফার উপর নজরদারি করা সম্ভব হবে। দ্বিতীয়ত, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি। এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকলে দুর্নীতি এবং অনিয়ম রোধ করা সম্ভব হবে।

তৃতীয়ত, নকল ওষুধের বাজার রোধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। নকল ওষুধ জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। সুতরাং, নকল ওষুধ উৎপাদন এবং বিপণনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। চতুর্থত, স্থানীয় বাজারে ওষুধের দাম স্থিতিশীল রাখতে রপ্তানি নীতিতে সমন্বয় আনা উচিত। প্রয়োজনে স্থানীয় বাজারের চাহিদা পূরণের পর ওষুধ রপ্তানির ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণের মাধ্যমে সরকার জনসাধারণের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করতে এবং জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে।

আমরা জানি, ওষুধ মানুষের জীবনের জন্য অপরিহার্য। এটি বিলাসপণ্যের মতো নয়, বরং মৌলিক চাহিদা। জনগণ আশা করে, সরকার ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেবে। চিকিৎসা ব্যয়ের চাপ কমাতে এবং সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।

অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি বন্ধ করতে হলে নিয়ম-নীতির কঠোর বাস্তবায়ন এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে। দেশীয় ওষুধ শিল্পের সাফল্য ধরে রাখতে এবং সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষায়, সঠিক পরিকল্পনা ও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।

শেষ কথা, ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে একটি গুরুতর সমস্যা। এই সংকট মোকাবিলায় সরকার, ব্যবসায়ী এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। ওষুধের দাম সবার নাগালের মধ্যে রাখা শুধু মানুষের মৌলিক অধিকারের বিষয় নয়, এটি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই সংকট সমাধানে সবার আন্তরিক প্রচেষ্টা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি স্বাস্থ্যসম্মত ও ন্যায়সঙ্গত পরিবেশ নিশ্চিত করবে।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।