বুধবার, ৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

শিল্প খাতে জ্বালানি সংকট: সমাধানের পথ কোথায়?

প্রকাশিতঃ ২৬ নভেম্বর ২০২৪ | ১০:৪২ পূর্বাহ্ন


নজরুল কবির দীপু : বাংলাদেশের শিল্প খাতের বর্তমান অবস্থা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং এবং সংকটময়। বিগত সরকারের আমলে এই খাত নানা দুর্দশার মধ্যে পড়ে ছিল, বিশেষত দুর্নীতি ও জ্বালানি সরবরাহের অপর্যাপ্ততা। এই দুই বড় বাধা শিল্পের উন্নয়ন এবং উৎপাদন ক্ষমতার ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। দেশের অর্থনীতি নির্ভরশীল শিল্প খাতের এই সংকট সঠিকভাবে মোকাবিলা করা না হলে, তা আরো বড় বিপদ ডেকে আনবে।

গত ২৩ নভেম্বর ঢাকা শহরের একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত একটি সেমিনারে বাংলাদেশের শিল্প খাতের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়। বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রি (বিসিআই) আয়োজিত এই সেমিনারে ব্যবসায়ীরা নিজেদের অভিজ্ঞতা এবং চ্যালেঞ্জগুলো শেয়ার করেছেন। সেমিনারে যে বিষয়টি উঠে এসেছে তা হলো, গ্যাস সংকটের কারণে দেশের বিভিন্ন শিল্প এলাকার উৎপাদন মারাত্মকভাবে কমে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম, ঢাকা, সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন শিল্প এলাকায় গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়ার কারণে বহু কারখানা বন্ধের উপক্রম হয়েছে। বিশেষত গ্যাসের অভাবে তৈরি পোশাক, স্টিল, সিরামিক এবং অন্যান্য উৎপাদনশীল খাতের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।

গ্যাসের চাহিদা বাড়লেও সরবরাহ করা হচ্ছে মাত্র অর্ধেকেরও কম। যা শিল্পের উৎপাদন ক্ষমতায় মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। তৈরি পোশাক খাতে ৩০-৩৫ শতাংশ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, স্টিল শিল্পে ২৫-৩০ শতাংশ এবং সিরামিক শিল্পে ৫০ শতাংশ উৎপাদন কমে গেছে। এর ফলে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, যা প্রত্যক্ষভাবে শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান এবং শিল্প মালিকদের ব্যবসায়িক অবস্থানকে হুমকির মুখে ফেলছে।

প্রতিদিন হাজার হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে, যা সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে দুর্বল করছে। ব্যবসায়ীরা এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের কাছে দুইটি প্রধান পদক্ষেপের দাবি জানিয়েছেন। এক, গ্যাস অপচয় এবং চুরি বন্ধ করতে হবে, এবং দুই, শিল্পের জন্য গ্যাস সরবরাহে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ, শিল্প খাতই দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি। তাই, যদি এই খাতে সমস্যার সমাধান না হয়, তাহলে দেশের অর্থনীতি আরও সংকটে পড়বে।

সেমিনারে উল্লেখ করা হয় যে, প্রতি বছর প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার গ্যাস অপচয় হয়ে থাকে, যা অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এই অপচয় বন্ধ করতে না পারলে দেশের গ্যাস খাত আরো বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। তাই ব্যবসায়ীরা সরকারের কাছে গ্যাসের অপচয় এবং চুরি বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। তাদের দাবি, সরকারি খাতে কেনাকাটার প্রতিযোগিতা থাকা উচিত, যাতে দুর্নীতি কমে যায় এবং জ্বালানি খাতে স্বচ্ছতা আনা যায়।

এছাড়া, সেমিনারে শিল্প খাতে দুর্নীতির বিষয়টি নিয়েও আলোচনা করা হয়। বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, “শিল্প খাতে গ্যাস সংযোগ পাওয়া ছিল দাসখত দেওয়ার মতো।” অর্থাৎ, শিল্প কারখানাগুলোর জন্য গ্যাস সংযোগ পেতে নানা ধরনের চাপের সম্মুখীন হতে হয়েছে এবং এই প্রক্রিয়াটি দুর্নীতির বড় উৎস ছিল। তিনি আরও বলেন, “গ্যাস সংযোগ পেতে সাবেক জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর বাসার সামনে বৃষ্টিতে ভিজতে হয়েছিল, যেন ব্যাংক লাইসেন্স পাওয়ার মতো।” এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, দেশের শিল্প খাতে গ্যাস সংযোগ পেতে সাধারণ ব্যবসায়ী এবং উদ্যোক্তাদের নানা ধরনের অনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সম্মুখীন হতে হয়েছে।

এবং সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হলো, গ্যাস সংযোগ পেতে এক ব্যবসায়ীকে তার কারখানায় গ্যাস আনার জন্য ৪০ কিলোমিটার গ্যাসলাইন বসাতে হয়েছে। শুধুমাত্র গ্যাসলাইনের জন্য তাকে ২০ কোটি টাকা চাঁদা দিতে হয়েছে। এই পরিস্থিতি পরোক্ষভাবে দেশের শিল্প খাতকে আরো দুর্বল করে তুলেছে এবং অব্যাহতভাবে ক্ষতির মুখে ফেলেছে।

তবে আশার কথা হলো, এসব অনিয়ম দূর করতে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার এই দুর্ব্যবস্থা দূর করার জন্য কাজ করছে এবং এখন সরকার কাজ করছে অর্থনীতিকে ক্রনি ক্যাপিটালিজম থেকে মুক্ত করতে। সেমিনারে জ্বালানি ও বাণিজ্য উপদেষ্টা জানান, বর্তমান সরকারের লক্ষ্য হলো শিল্প খাতে গ্যাস সরবরাহে স্বচ্ছতা আনা এবং এটি আগামী ২০৩০ সাল পর্যন্ত স্থিতিশীল রাখার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া।

তবে, এই পরিস্থিতির পূর্ণাঙ্গ সমাধান করতে হলে সরকারের পাশাপাশি শিল্প মালিকদেরও কিছু দায়বদ্ধতা রয়েছে। প্রথমত, সরকারকে গ্যাস সরবরাহে স্বচ্ছতা আনতে হবে এবং শিল্পখাতে যে চাহিদা রয়েছে তা পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি, উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার ক্ষেত্রে কারখানা মালিকদেরও উচিত প্রযুক্তির সাহায্যে শক্তির অপচয় কমানো এবং কার্যকর গ্যাস ব্যবস্থাপনা চালু করা।

এছাড়া, শিল্প খাতে জ্বালানির অপচয় এবং চুরি রোধে নজরদারি বৃদ্ধি করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট বিভাগের মধ্যে জবাবদিহি এবং গতিশীল নীতিমালা গ্রহণ করা। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো যদি কার্যকরভাবে দায়িত্ব পালন করে, তবে খাতটির উন্নতি সম্ভব। পাশাপাশি, দেশের শিল্প খাতে নতুন নীতিমালা প্রণয়ন এবং সেগুলোর যথাযথ প্রয়োগ শিল্পের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে।

সরকারের কাছে এখন প্রধান লক্ষ্য হতে হবে – দেশের শিল্প খাতকে শক্তিশালী করা, যাতে অর্থনীতির মূল চাকা চলতে থাকে। শিল্প খাতের ভিত শক্ত করতে হলে, সবার আগে জ্বালানি সংকট সমাধান করতে হবে এবং এর জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়া, দুর্নীতি, অপচয়, এবং অনিয়মের বিরুদ্ধে জোরালো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কিছু দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপও নিতে হবে, যেমন – বিকল্প জ্বালানির উৎস খুঁজে বের করা, শক্তির সাশ্রয়ী প্রযুক্তি ব্যবহার করা, এবং শক্তির মানসম্পন্ন ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা। যদি এই পদক্ষেপগুলো সঠিকভাবে গ্রহণ করা যায়, তবে শিল্প খাত উন্নতির দিকে যেতে সক্ষম হবে। এর ফলে, দেশের অর্থনীতির বিকাশ সম্ভব হবে এবং দেশের সাধারণ মানুষও এর সুফল পাবে।

সবশেষে, সরকার এবং শিল্প খাতের মালিকদের যৌথ উদ্যোগে যদি এই সংকট সমাধানের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, তবে বাংলাদেশের শিল্প খাত আবারও শক্তিশালী হয়ে উঠবে এবং দেশের অর্থনীতি আরও সমৃদ্ধ হবে।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।