বুধবার, ৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

অস্থিরতা রুখতে সরকার ও জনগণের সম্মিলিত প্রয়াস প্রয়োজন

প্রকাশিতঃ ৩০ নভেম্বর ২০২৪ | ৯:৫৪ পূর্বাহ্ন

নজরুল কবির দীপু
নজরুল কবির দীপু : গত কিছু মাসে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে অবনতির ছবি ফুটে উঠেছে, তা শুধু পরিসংখ্যানেই নয়, প্রতিদিনের জীবনে দৃশ্যমান। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটে গেছে ৫২২টি হত্যাকাণ্ড। পাশাপাশি, খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি, চুরি, দস্যুতাসহ নানা অপরাধে মোট ২৫,৪৫৬টি মামলা হয়েছে। তবে এসব পরিসংখ্যানের চেয়ে বড় প্রশ্ন হলো—এই ধরনের অপরাধমূলক ঘটনা কি শুধু সংখ্যা বৃদ্ধি করছে, নাকি মানুষের জীবনযাত্রাকে বিপজ্জনক করে তুলছে?

আমাদের শহর ও গ্রামের প্রতিটি কোণে এখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এক ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও হত্যাকাণ্ড ঘটছে, বড় শহরেও বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ, গণপিটুনি এবং রাস্তা অবরোধের মতো ঘটনাগুলো প্রায় রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু তাই নয়, গত তিন মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে গণপিটুনিতে অন্তত ৬৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। আর এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রমের অকার্যকরতা।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে বেশ কিছু গুরুতর প্রশ্ন উঠছে। সম্প্রতি, সরকার পুলিশকে আরও সক্রিয় করতে এবং বেআইনি সমাবেশের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে সেনাবাহিনীকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—তবুও কেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে না?

এমন অনেক ঘটনা ঘটছে যেখানে পুলিশ কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না। ঢাকার কিছু কলেজে শিক্ষার্থীদের হামলা এবং ভাঙচুরের ঘটনায় পুলিশ তেমন কোনো প্রস্তুতি নেয়নি। একই ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রামে, যেখানে ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ নিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে পারে, এমন সাধারণ বিষয়টি পুলিশের নজর এড়িয়ে গেছে। যার কারণে আইনজীবী হত্যার ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ করেছেন আইনজীবী নেতারা। এসব ঘটনায় পুলিশের গোয়েন্দা কার্যক্রম ও আগাম প্রস্তুতির অভাব স্পষ্ট। এটি শুধু একটি সিস্টেমের দুর্বলতা নয়, বরং পুরো নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রতি অবহেলা এবং দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচায়ক।

দেশের বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কখনো কখনো নৈরাজ্যের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। বিভিন্ন দাবির নামে অহেতুক রাস্তা অবরোধ এবং ভাঙচুরের ঘটনায় সাধারণ মানুষ একদিকে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, অন্যদিকে সারা দেশে অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে। দেশে চলমান এই অস্থিরতা দেশের অর্থনীতি এবং উন্নয়নকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বিশেষ করে, দেশের প্রধান রপ্তানি খাত—পোশাক শিল্পেও এর প্রভাব পড়ছে। পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের আন্দোলন, সড়ক অবরোধ এবং বিক্ষোভের কারণে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য হুমকি।

এ প্রেক্ষাপটে সরকারের বিশেষত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে। দেশব্যাপী সংঘটিত এসব নৈরাজ্য ও অপরাধমূলক ঘটনা সামাল দিতে হলে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। এর জন্য একদিকে যেমন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রমে গতিশীলতা আনা জরুরি, তেমনি সামাজিক শান্তির জন্য জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করাও প্রয়োজন।

গণপিটুনির মতো ঘটনায় আমরা আজ উদ্বিগ্ন। যে ৬৮টি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, সেখানে কোনো বিচারবিভাগীয় প্রক্রিয়া না হওয়ায় সাধারণ মানুষ নিজেদের বিচার করতে বাধ্য হচ্ছে। এটা সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের এক ভয়ানক চিত্র। গণপিটুনি কোনো সমস্যার সমাধান নয়; বরং এটি অপরাধ এবং আইনশৃঙ্খলার আরও অবনতি ঘটায়। তাই এই ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আগে, প্রশাসনকে আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

আমরা দেখছি, বিভিন্ন দাবির নামে সড়ক অবরোধ, বিক্ষোভ, ভাঙচুর—এগুলো একে একে বেড়ে চলেছে। অথচ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসবের মোকাবিলা করতে একেবারেই প্রস্তুত নয়। এর জন্য প্রথমত সরকারের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও শক্তিশালী ও সজ্জিত করা দরকার। সাধারণ মানুষকে এই বিক্ষোভ এবং নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে সচেতন করতে হবে। একই সঙ্গে, পুলিশের গোয়েন্দা কার্যক্রমকে আরও উন্নত করতে হবে যাতে এসব অস্থিরতা আগে থেকেই আঁচ করা যায় এবং সেভাবে প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হয়।

অপরদিকে, সরকারকে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। যেসব ক্ষেত্রে মানুষের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, সেসব ক্ষেত্রে সরকারের সক্রিয় পদক্ষেপ প্রয়োজন। রাষ্ট্র যদি আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে দৃঢ় ব্যবস্থা না নেয়, তবে জনগণের মধ্যে আইন-শৃঙ্খলার প্রতি আস্থা কমে যাবে।

তবে, এককভাবে পুলিশ কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দোষ দেওয়া যথাযথ নয়। এটা মূলত সরকারের একটি বৃহত্তর সমস্যা, যেখানে প্রশাসনের অবহেলা এবং অব্যবস্থাপনা স্পষ্ট। তাই, সরকারের সর্বস্তরের কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত, যেখানে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে জনসাধারণের নিরাপত্তা ও ন্যায়ের প্রতি বিশ্বাস পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।

এটা নিশ্চিত করতে হবে যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জনগণের মধ্যে আস্থা তৈরির জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত, এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরের মধ্যে একটি সমন্বিত উদ্যোগ রয়েছে। সড়ক অবরোধ এবং বিক্ষোভের মতো অপরাধগুলো যদি বন্ধ না হয়, তবে তা শুধু আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাবে, বরং জনমনে এক অস্থির পরিবেশ সৃষ্টি করবে।

শেষ কথা- বাংলাদেশের বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করছে। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড যেমন বাড়ছে, তেমনি মানুষের নিরাপত্তাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট, কার্যকর পদক্ষেপ। সরকারের উচিত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রস্তুতিকে শক্তিশালী করা এবং সামাজিক শান্তির জন্য জনগণকে সচেতন করা। যাতে আমরা একটি নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ে তুলতে পারি, যেখানে অপরাধীরা শাস্তি পাবেই, এবং সাধারণ মানুষ নিরাপদেই চলাফেরা করতে পারে।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।