বুধবার, ৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

চন্দ্রঘোনায় ফেরির যন্ত্রণা থেকে মুক্তি কবে?

প্রকাশিতঃ ৩০ নভেম্বর ২০২৪ | ৯:৩৭ অপরাহ্ন


এম মোয়াজ্জেম হোসেন, রাঙ্গুনিয়া (চট্টগ্রাম): স্বাধীনতার পর দীর্ঘ ৫২ বছর ধরে একটি সেতুর স্বপ্নে দিন কাটাচ্ছেন তিন পার্বত্য জেলার লাখ লাখ মানুষ। বর্তমানে তাদের চলাচলের একমাত্র সম্বল নদীর উপর দুটি ফেরির সার্ভিস।

চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলা, বান্দরবান, কাপ্তাই ও রাঙ্গামাটির যোগাযোগের সংযোগস্থল কর্ণফুলী নদীর চন্দ্রঘোনা ফেরিঘাট। লুসাই পাহাড় থেকে প্রবাহিত কর্ণফুলী নদীর উপর একমাত্র ফেরি পারাপার ব্যবস্থা চালু রয়েছে রাইখালী, চন্দ্রঘোনা, রাজস্থলী ও বান্দরবানে। কর্ণফুলী নদীতে চালু থাকা এই ফেরি সার্ভিসের উত্তর পাশে চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনিয়া বাণিজ্যিক কেন্দ্র লিচুবাগান, আর দক্ষিণে রাঙামাটি জেলাধীন কাপ্তাই উপজেলার রাইখালী ইউনিয়ন।

এই দুই জেলার মাঝে সেতুবন্ধন রচনা করেছে এই ফেরি সার্ভিস। নদীর দুই পাড় দুই জেলায় অবস্থিত হলেও তিন পার্বত্য জেলার বাসিন্দারা এই সড়ক বেশি ব্যবহার করেন। যেমন রাজস্থলী, রাইখালী, বান্দরবান, কাপ্তাই ও রাঙ্গুনিয়া উপজেলার বাসিন্দারাও এখান দিয়ে যাতায়াত করেন।

এই পথ দিয়ে প্রতিদিন সরকারি-বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন কর্মকর্তাদেরও চলাচল। এছাড়াও সেনাবাহিনী, বিজিবি, র‍্যাব, পুলিশ ও বন বিভাগের গাড়িসহ শত শত যাত্রীবাহী বাস, জিপ, অটোরিকশা ও পণ্যবাহী ট্রাক চলাচল করছে এই পথ দিয়েই। কিন্তু ফেরি দিয়ে যাতায়াতের কারণে এসব যানবাহনকে বিভিন্ন সময়ে পড়তে হয় চরম বিপাকে। কখনো ফেরি নষ্ট, কখনো বর্ষাকালে নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ফেরি বন্ধ থাকা সহ আরও অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয় তাদের। যেহেতু যান ও জন চলাচলের জন্য একটি কিংবা দুটি ফেরি যথেষ্ট নয় এবং চলাচলের মাধ্যম যেহেতু ফেরি, সেক্ষেত্রে জরুরি মুহূর্তেও সহজে গন্তব্যে পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে।

রাঙামাটি হয়ে বান্দরবানে যাতায়াতের জন্য একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে রাঙ্গুনিয়ার চন্দ্রঘোনা কর্ণফুলী নদীর এই ফেরি। কাপ্তাই অংশেও চন্দ্রঘোনার যানবাহন পারাপারের মাধ্যম সওজের ফেরি। কিন্তু নদীতে বালুচর ওঠা, পাহাড়ি ঢল সহ নানা কারণে প্রায়ই আটকে যায় ফেরিটা। এ সময় চরম বেকায়দায় আটকে থাকতে দেখা যায় শত শত যানবাহনকে। এর বাইরেও এই সেতু স্বাভাবিক নিয়মে পার হতে গেলে প্রায় এক ঘণ্টা সময় ব্যয় হয়। তাই সেতুটি হওয়া খুবই প্রয়োজন বলে মনে করছেন স্থানীয় সহ তিন পার্বত্য এলাকার চালক ও যাত্রী সহ সকলে।

জানা যায়, রাঙামাটি সড়ক ও জনপথ বিভাগ ১৯৮৪ সালে চন্দ্রঘোনায় ফেরি সার্ভিস চালু করে। এশিয়ার বিখ্যাত কর্ণফুলী কাগজ কলের কাঁচামাল আহরণ সহ পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় উৎপাদিত বাঁশ, গাছ, মৌসুমি ফলমূল, তরকারি সহ বিভিন্ন মালামাল প্রতিদিন এই ফেরি দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়। কিন্তু বান্দরবান ও রাজস্থলী থেকে চট্টগ্রাম-কাপ্তাই-রাঙামাটি জেলার সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সমস্যা লাঘবে এই ফেরি যথেষ্ট নয়। বান্দরবান থেকে খুব ভোরে বাসে উঠে চট্টগ্রাম বা রাঙামাটির উদ্দেশে রওনা দিলেও ফেরি সমস্যার কারণে যাত্রীদের যথাসময়ে গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব হয় না।

চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া সহ উল্লেখিত তিন পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে চন্দ্রঘোনা ফেরিঘাট দিয়ে সেতু নির্মাণের প্রত্যাশায় দিন কাটাচ্ছেন। স্বাধীনতার পর থেকে এই অপেক্ষায় দিন কাটছে এই পথে চলাচলকারী লাখ লাখ মানুষের। মাঝেমধ্যেই খবর আসে, সেতু নির্মাণের প্রকল্প একনেকে পাসের। মানুষ আশায় বুক বাঁধে, কিন্তু পরক্ষণেই সেই খবরও গুজব বলে প্রমাণিত হয়। সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্যরাও একই আশ্বাস দিয়েছেন একাধিকবার, কিন্তু সেতু আর হয় না।

সর্বশেষ সেতু নির্মাণের জন্য সম্ভাব্যতা অধ্যয়ন ও নকশা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে। নকশা প্রণয়ন সহ সম্ভাব্যতার প্রতিবেদন সওজ’র সেতু বিভাগে দেওয়ার পর তা পরিকল্পনা কমিশন হয়ে তারপর একনেকে উঠবে। এর যেকোনো ধাপে এই প্রকল্প বাতিল করা হলে সেক্ষেত্রে সেতুর স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে। তাই এখনো অনিশ্চিত চন্দ্রঘোনা ফেরিঘাট সেতুর কাজ। তবে আশার কথা হচ্ছে সম্ভাব্যতা যাচাই ও নকশা প্রণয়নের কাজের মাধ্যমে চন্দ্রঘোনা ফেরিঘাট সেতু নির্মাণের প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে।

সম্প্রতি এশিয়ান ইনফু স্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের অর্থায়নে প্রকল্প পরামর্শদাতা এসিই কনসালটেন্ট লিমিটেড এর আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ এই সেতু নির্মাণে বিস্তারিত সম্ভাব্যতা অধ্যয়ন ও নকশা প্রণয়ন প্রকল্পের আর্থ-সামাজিক ও পরিবেশ সম্পর্কিত মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সেতু নির্মাণ করলে যাদের জমি এবং ঘর সহ ক্ষতির মুখে পড়বে তারা সহ স্থানীয়রা মত প্রকাশ করেন এবং সকলেই ক্ষতিপূরণ সাপেক্ষে সেতু নির্মাণের জোর সুপারিশ করেন।

সভায় বক্তব্য দেন প্রকল্পের সোশ্যাল এন্ড রিসেটেইলমেন্ট বিশেষজ্ঞ মো. ওয়ালিদ আক্তার এবং রাহাত খান মজলিশ।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ফেরিঘাট সেতু নির্মাণের জন্য নকশা প্রণয়ন ও সম্ভাব্য ক্ষতি সহ অন্যান্য নয় আর্থ-সামাজিক বিষয় যাচাই করার কাজ করছেন তারা। ৪৭০-৮০ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি সেতু হতে পারে। এজন্য তারা নকশা প্রণয়ন সহ প্রাথমিক কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এই সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন তারা সওজ’র সেতু বিভাগে দেবেন এবং সেখান থেকে পরিকল্পনা কমিশন হয়ে একনেকে উঠে চূড়ান্ত অনুমোদন পাবে। এরপর টেন্ডার প্রক্রিয়ার সাহায্যে মূল সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হবে। তবে বিষয়টি সময় সাপেক্ষ বলেও জানা যায়।

জানা যায়, রাঙ্গুনিয়া-কাপ্তাইয়ের কর্ণফুলী নদী তীরের দু’পাড়ের লোকজনের দীর্ঘ সময়ের দাবি এই সেতু। ১৯৮৯ সালে কর্ণফুলী নদী পারাপারের জন্য ফেরি সার্ভিস চালু হয়। বর্তমানে রাঙামাটি সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের অধীনে ফেরিটি পরিচালিত হচ্ছে। ১৯৯৩ সালে তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী অলি আহমদ লিচু বাগান ফেরি ঘাটে সেতু নির্মাণ করার জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন সহ ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে লিচু বাগান ফেরিঘাটে সেতু নির্মিত না হয়ে গোডাউন দিয়ে কর্ণফুলী নদীর উপর সেতু নির্মাণ করা হয়। এরপর থেকে লিচু বাগান ফেরিঘাটে সেতু নির্মাণ করার জন্য আর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

স্থানীয় বাস চালকরা জানান, “লিচু বাগান ফেরিঘাটে সেতু না থাকায় লিচু বাগান এবং রাইখালীতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকে মানুষকে ভোগান্তি পোহাতে হয়। এখানে সেতু নির্মিত হলে মানুষের ভোগান্তি কমার পাশাপাশি তিন পার্বত্য জেলায় যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হবে। পাশাপাশি কৃষি উন্নয়ন বাড়বে এবং মানুষের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে।”

সেতু নির্মাণ প্রসঙ্গে সওজ রাঙামাটি বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী কির্ত্তী নিশান চাকমা জানান, “সেতু নির্মাণের বিষয়টি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। সম্ভাব্য যাচাই, ক্ষতি নিরূপণ ও নকশা প্রণয়নের জন্য একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাদের প্রতিবেদন আমাদের সেতু বিভাগের মাধ্যমে প্রকল্প প্রণয়নের জন্য একনেকে যাবে, এসব দীর্ঘসূত্রিতার বিষয়। তবে সেতু নির্মাণের প্রাথমিক ধাপ শুরু হয়েছে।