
একুশে প্রতিবেদক : বাংলাদেশে ক্যান্সারের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে দ্রুত, কিন্তু ক্যান্সারের চিকিৎসায় সেবা, সরঞ্জাম এবং দক্ষ জনবল নিয়ে বেশ কিছু বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। দেশে ক্যান্সারের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল, তবে সেবার মান এবং পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধার অভাবও রোগীদের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়া রোগীদের জন্য কিছুটা স্বস্তি হলেও, সম্প্রতি দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপড়েনের কারণে সেখানে ভিসা পেতে দীর্ঘসূত্রতা এবং ভোগান্তি সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে অনেক ক্যান্সার রোগী এখন দেশে চিকিৎসা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও সেবার মান এবং ব্যয়ের দুশ্চিন্তা তাদের পিছু ছাড়ছে না।
চট্টগ্রামের বাসিন্দা রহিমা বেগম চল্লিশোর্ধ্ব একজন নারী, যিনি এক বছর ধরে ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত। তিনি নিয়মিতভাবে চিকিৎসার জন্য প্রতিবেশী দেশ ভারত যেতেন। কিন্তু সম্প্রতি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের জটিলতায় ভারতের ভিসা পেতে সমস্যা হওয়ার পর তিনি সিদ্ধান্ত নেন, দেশেই চিকিৎসা নিবেন। তবে দেশের হাসপাতালগুলোর চিকিৎসা সেবা এবং খরচ নিয়ে তার উদ্বেগ রয়েছে।
রহিমা জানান, “দেশের একটি হাসপাতালে পেটের সিটি স্ক্যান করাতে খরচ হয় ৬৫ হাজার টাকার মতো, কিন্তু ভারতে এ খরচ ২৪ হাজার রুপি। সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা সস্তা হতে পারে, কিন্তু সবাই সেখানে সুযোগ পায় না, এজন্য আমার মতো অনেক ক্যান্সার রোগী ভারতে যায় চিকিৎসার জন্য।”
ক্যান্সারের চিকিৎসা দেশের মধ্যে যে বৈশ্বিক মানের সুযোগ নেই, তা একাধিক গবেষণার ফলাফলে উঠে এসেছে। যদিও দেশে প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক ক্যান্সার রোগী শনাক্ত হচ্ছে, তবে ক্যান্সারের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং দেশের চিকিৎসা সুবিধা এবং সেবা এখনো উন্নত পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি।
বাংলাদেশে ২০২২ সালে নতুন করে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে ১ লাখ ৬৭ হাজার ২৫৭ জন, এবং একই বছরে ক্যান্সারের কারণে মৃত্যু হয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ৫৯৮ জনের। এভাবে প্রতি বছর ক্যান্সার শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, যার সাথে বাড়ছে চিকিৎসা খরচও।
ক্যান্সার চিকিৎসা অত্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া, এবং একবার শুরু করলে রোগী সেই চিকিৎসককেই অবিরত দেখতে চায়, কারণ চিকিৎসার মাঝপথে চিকিৎসক পরিবর্তন মানসিক উদ্বেগ সৃষ্টি করতে পারে, যা চিকিৎসার ফলাফলেও বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। সম্মান ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. রুবাইয়ুল মুর্শেদ বলেন, “ক্যান্সারের চিকিৎসার ক্ষেত্রে রোগীর মানসিক স্বাস্থ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যখন রোগীকে চিকিৎসক পরিবর্তন করতে হয়, তখন রোগীর মধ্যে মানসিক উদ্বেগ তৈরি হয়, যা চিকিৎসায় বিরূপ প্রভাব ফেলে।”
এছাড়া, বাংলাদেশের বেশিরভাগ সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ক্যান্সারের চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকট রয়েছে। বিশেষ করে রেডিওথেরাপি মেশিনের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ এবং নতুন যন্ত্রপাতি সরবরাহের অভাবে চিকিৎসা সেবা দিতে কষ্ট হচ্ছে। দেশের কিছু সরকারি হাসপাতালগুলোতে মেশিন রয়েছে, কিন্তু পর্যাপ্ত জনবল নেই। আবার কিছু হাসপাতালগুলোতে জনবল রয়েছে, কিন্তু মেশিনের অভাব রয়েছে। এইসব সমস্যার কারণে ক্যান্সার রোগীদের অনেক সময় চিকিৎসা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যদি সরকারের পক্ষ থেকে জনবল এবং যন্ত্রপাতি বাড়ানো যায়, তবে দেশে আরও অনেক ক্যান্সার রোগীকে সময়মতো চিকিৎসা প্রদান সম্ভব হবে।
গ্লোবাল ক্যান্সার অবজারভেটরির ২০২২ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার পর মৃত্যু হার উল্লেখযোগ্যভাবে উচ্চ।
এদিকে, ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য প্রতিবেশী দেশ ভারতে যাওয়া বাংলাদেশি রোগীদের সংখ্যা প্রতি বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়া রোগীরা বছরে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে, যা বাংলাদেশের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ।
কিন্তু ভারতের সঙ্গে সাম্প্রতিক কূটনৈতিক টানাপড়েনের কারণে, সেখানকার চিকিৎসাসেবা এখন অনেক বাংলাদেশির জন্য দূরের স্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভিসা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে এবং দীর্ঘসূত্রতার কারণে রোগীরা নতুন অ্যাপয়েন্টমেন্ট বা ফলোআপ নিয়ে সমস্যায় পড়ছেন।
এছাড়া, বাংলাদেশের অনেক ক্যান্সার রোগী বিশেষ করে নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো এই চিকিৎসার ব্যয় বহন করতে হিমশিম খাচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব কমিউনিটি মেডিসিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথের একটি গবেষণায় বলা হয়, ক্যান্সারের চিকিৎসা এতটাই ব্যয়বহুল যে, নিম্ন-মধ্যবিত্ত জনগণের পক্ষে তা চালানো কঠিন। আর এ কারণে তারা মাঝপথে চিকিৎসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছে। একদিকে চিকিৎসার ব্যয়, অন্যদিকে সরকারের হাসপাতালগুলোতে সেবার মানের অভাব, সব মিলিয়ে ক্যান্সার রোগীদের সামনে একটি অন্ধকার ভবিষ্যত হতে পারে।
মেডিকেল অ্যান্ড রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট ডা. মো. তৌছিফুর রহমান বলেন, “ক্যান্সার চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল। তবে বাংলাদেশেও আন্তর্জাতিক মানের ক্যান্সার চিকিৎসা দেয়া সম্ভব। সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোর জনবল এবং রেডিওথেরাপি মেশিন দুটোই বাড়ানো উচিত। তাহলে আমরা অনেক রোগীকে চিকিৎসা দিতে সক্ষম হব।” তার মতে, রেডিওথেরাপি এবং কেমোথেরাপি মেশিনগুলো দ্রুত সংস্কার এবং নতুন মেশিন সরবরাহ করতে হবে, যাতে দেশের ক্যান্সার রোগীরা সময়মতো চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের ক্যান্সার চিকিৎসায় এই সংকট কাটানোর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। সরকার যদি রোগীদের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং দক্ষ চিকিৎসক নিয়োগের ব্যবস্থা করে, তবে রোগীরা দেশে উপযুক্ত চিকিৎসা নিতে পারবেন। এছাড়া, ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য সরকারি হাসপাতালগুলোকে আরও আধুনিক এবং বিশ্বমানের করা গেলে, প্রতিবেশী দেশগুলোর উপর নির্ভরতা কমানো সম্ভব হবে। সেইসাথে, ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের জন্য চিকিৎসা ব্যয়ের বিষয়ে আর্থিক সহায়তা বা বীমার ব্যবস্থা করলে, অনেক রোগী সহজে চিকিৎসা নিতে সক্ষম হবেন।
অপরদিকে, সারা বিশ্বে ক্যান্সারের চিকিৎসা উন্নত হওয়ায়, বাংলাদেশের চিকিৎসার মান বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। ক্যান্সার চিকিৎসায় আধুনিক প্রযুক্তি ও সেবা প্রদান করা গেলে রোগীদের সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা অনেক বাড়ানো যাবে। তাই সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত, ক্যান্সার চিকিৎসা ব্যবস্থার সংকট কাটিয়ে রোগীদের জন্য উন্নত সেবা নিশ্চিত করা।
