রহমানিয়া উচ্চ বিদ্যালয় : শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নাকি ‘মোবারক মার্কেট’?

একুশে প্রতিবেদক : “যে জাতি সফল মানুষদের মূল্যায়ন করে না, সে জাতিতে সফল মানুষের জন্ম হয় না।” – এই উক্তিটি করেছিলেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) সদ্য সাবেক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। ২০২৩ সালের ১৩ মার্চ ‘নগর নেতৃত্ব’ শ্রেণিতে বিশেষ অবদান রাখায় কাউন্সিলর মো. মোবারক আলীকে ‘মেয়র পদক’ প্রদানের সময় তিনি এ কথা বলেন। বাহ্, কী চমত্‍কার উক্তি! মোবারক আলীর মতন “সফল” মানুষদের মূল্যায়ন না করলে কি চলে?

কিন্তু, কীভাবে “সফল” হলেন সদ্য সাবেক কাউন্সিলর মোবারক আলী? আসুন, একটু পিছনে ফিরে দেখি।

চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ থানাধীন হামজারবাগ এলাকায় চট্টগ্রাম-হাটহাজারী সড়কের পাশে অবস্থিত রহমানিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের জমিতে অবৈধভাবে ১৩টি দোকান গড়ে তোলার অভিযোগ উঠেছে এই “সফল” মানুষ মোবারক আলী ও তার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, শামস মনি ফুডস কর্ণার নামক দোকানের মালিক পরিচয়ে একটি দোকান নিজের স্ত্রীর নামে নামমাত্র ভাড়ায় নিয়েছেন তিনি। সেই একটি দোকানকে পরে কাজী ফার্মস ও পল্লী মঙ্গল ফার্মেসি নামের দুটি দোকানে পরিণত করেছেন তিনি। একেবারে “সফল” ব্যক্তির “সফল” স্ত্রী!

১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত স্কুলটির সীমানা দেওয়াল ভেঙে ২০১৩ সালের দিকে দোকানগুলো নির্মাণ করা হয়। যেন স্কুলের জমি তাদের বাপ-দাদার সম্পত্তি! চট্টগ্রাম-হাটহাজারী সড়কের বাম পাশে স্কুলের সাথে ৯টি দোকান এবং সড়ক থেকে বাম দিকে স্কুলে প্রবেশের রাস্তার ডান পাশে আরও ৪টি দোকান নির্মাণ করা হয়। দোকানগুলোর মধ্যে রয়েছে কাজী ফার্মস, পল্লী মঙ্গল ফার্মেসি, মাহি এন্টারপ্রাইজ, গাউসিয়া ফল বিতান, মধুবন, বাটার শোরুম, আরাফাত ট্রেডিং করপোরেশন, আজমীর এন্টারপ্রাইজ, এবং এস আর ট্রেডার্স।

অভিযোগ? নামমাত্র সালামি ও মাসিক ভাড়ায় আওয়ামী লীগ নেতাদের যোগসাজশে দোকানগুলো বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এমনকি, সেই নামমাত্র ভাড়াও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে পরিশোধ করছেন না তারা। বাহ্, কী চমত্কার “সফল” ব্যবসায়িক কৌশল!

এর মধ্যে, কাজী ফার্মস এবং পল্লী মঙ্গল ফার্মেসি নামক দোকান দুটি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) ৭নং ওয়ার্ড এর সাবেক কাউন্সিলর মোবারক আলীর স্ত্রী নুর-এ-শামসুন নেছার নামে বরাদ্দ নেওয়া। শামস মনি ফুডস কর্ণার নামক দোকানের মালিক পরিচয়ে বরাদ্দ নিলেও, পরবর্তীতে সেখানে কাজী ফার্মস এর আউটলেট স্থাপন করা হয়। পরে কাজী ফার্মস এর আউটলেট ছোট করে বাকি জায়গায় স্থাপন করা হয় পল্লী মঙ্গল ফার্মেসি। একেবারে “ফুড কর্ণার” থেকে “ফার্মেসী” – রাতারাতি ব্যবসায়িক পটপরিবর্তন!

২০১৭ সালের ১৮ অক্টোবর স্বাক্ষরিত চুক্তিপত্র অনুযায়ী, দোকানটি স্কুলের “ভোগ দখলে থাকা খাস বা সরকারি জায়গায়” গড়ে তোলা হয়েছে। কোন দরপত্র, নিলাম বা লটারি নয়, নুর-এ-শামসুন নেছার আগ্রহের ভিত্তিতে দোকানটি ভাড়া দেওয়া হয়েছে। ১২০ বর্গফুটের দোকানটির জন্য মাত্র ৪ লাখ টাকা সালামি (জামানত) ও মাসিক ভাড়া মাত্র আড়াই হাজার টাকা ধরা হয়। এ যেন “সফল” মানুষদের জন্য “সফল” আয়োজন!

কিন্তু সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, দোকানটির আয়তন ৩০০ বর্গফুটের কাছাকাছি। শহরের প্রধান অংশে, ব্যস্ত সড়কের পাশে, প্রশস্ত ফুটপাতের পাশে অবস্থিত দোকানটির ভাড়া ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা বা তার বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু “সফল” মানুষদের জন্য তো সবই “নামমাত্র”!

স্থানীয়দের অভিযোগ, স্ত্রীর নাম ব্যবহার করে মোবারক আলী নামমাত্র মূল্যে দোকানটি ভাড়া নিয়েছেন এবং কাজী ফার্মস এর আউটলেট স্থাপনের মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। কী চমত্‍কার “পারিবারিক” ব্যবসা!

দোকান বরাদ্দ ও নির্মাণ প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিল মোবারক আলীর সিন্ডিকেটের অন্যতম প্রধান সদস্য হিসেবে পরিচিত নগরের ৭নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক এসকান্দার মিয়ার নেতৃত্বাধীন স্কুল পরিচালনা কমিটি। ১২ বছর ধরে সভাপতি থাকা এসকান্দার মিয়ার সাথে কমিটিতে ছিলেন ৭নং ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক সভাপতি দেলোয়ার হোসেন বাবুল, ৭ নং ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. আজিজ, ইউনিট আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মো. নাসির প্রকাশ লোহা নাসির, এবং নারী সদস্য শাহনাজ বেগম তামান্না। এক কথায়, “সফল” মানুষদের “সফল” সিন্ডিকেট!

মোবারক আলীর স্ত্রী নুর-এ-শামসুন নেছাকে দোকান ভাড়া দেওয়ার চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন সেই সময়ের প্রধান শিক্ষক আবু তৈয়ব আশরাফী। স্কুলের জায়গায় দোকান বরাদ্দে অনিয়মের প্রসঙ্গ তুলে ধরা হলে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ নেতাদের ও স্কুল কমিটির চাপে দোকান বরাদ্দের চুক্তিপত্রে তিনি সই করতে বাধ্য হয়েছেন। অসুস্থতার কথা জানিয়ে তিনি আর কথা বলতে রাজি হননি। চাপের মুখে অসহায় শিক্ষক!

অভিযোগ রয়েছে, নতুন বিজ্ঞান ভবন নির্মাণ বাবদ এই কমিটি (এসকান্দার মিয়ার নেতৃত্বাধীন) প্রধান শিক্ষকের সাথে যোগসাজশে প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা উত্তোলন করে নিলেও, বাস্তবে বিজ্ঞান ভবন নির্মাণে আড়াই থেকে তিন কোটি টাকা খরচ হয়েছে। তাহলে বাকি টাকা কোথায়?

পরবর্তীতে, মোসলেম উদ্দিন আহমেদ বোয়ালখালী-চান্দগাঁও আসনের এমপি হওয়ার পর ঐ কমিটি বাতিল করে এডহক কমিটি গঠনের ব্যবস্থা করেন, যার প্রধান ছিলেন তিনি নিজেই। মোসলেম উদ্দিন আহমেদ মারা যাওয়ার পর এডহক কমিটির প্রধান হন মোবারক আলীর সৎ ভাই তালেব আলী। পরিবারতন্ত্রের কী চমত্‍কার উদাহরণ!

তালেব আলী নেতৃত্বাধীন এডহক কমিটি দুর্নীতির দায়ে সাবেক প্রধান শিক্ষক আবু তৈয়ব আশরাফীকে চাকুরিচ্যুত করে।তখন থেকেই স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক জেবুন্নেছা খানম ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন।

অবৈধভাবে দোকান তৈরি ও দোকান বরাদ্দে অনিয়মের বিষয়টি স্বীকার করেছেন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জেবুন নিছা খানম। তবে, চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ায় দোকানগুলো উচ্ছেদ বা বরাদ্দ বাতিলের বিষয়ে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। দোকানগুলো উচ্ছেদ না করার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “দোকানগুলোর ভাড়া অনেক মাস ধরে বকেয়া রয়েছে। এখন উচ্ছেদ করলে বকেয়া টাকা ফেরত পেতে সমস্যা হবে।” এই বিষয়ে স্কুলের বর্তমান সভাপতি জেলা প্রশাসক বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে কিনা প্রশ্নের জবাবে তিনি “না” বলে উত্তর দেন।

৫ আগস্টের পর থেকে এসকান্দার মিয়া, মোবারক আলীসহ অভিযুক্তরা আত্মগোপনে আছেন। তাদের মুঠোফোন নাম্বারও বন্ধ। অভিযোগের বিষয়ে তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এমনকি, ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জেবুন নিছা খানমও এসকান্দার মিয়ার সাথে যোগাযোগের ব্যক্তিগত নাম্বার দিতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি বলেন, “নাম্বারটি আপনি আর কারও কাছ থেকে পেয়ে যাবেন, আমি দিতে চাচ্ছি না।”

তবে আরাফাত ট্রেডিং-এর মালিক নুরুল হুদা মোল্লার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়েছে। তিনি স্পষ্টতই স্বীকার করেছেন যে তিনি দোকানটি অন্য একজনের কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছেন। ভাড়া পরিশোধের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলেন, “স্কুলে কমিটি না থাকায় ভাড়া দিচ্ছি না।” ভাড়ার পরিমাণ জানতে চাইলে তিনি জানান, “২৩০০-২৪০০ টাকা”।

ভাড়া এত কম কেন, এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “২৪০০ টাকাও তো আমার উঠে না। খাবারের দোকানগুলো ব্যবসা করছে, কিন্তু এখন (আমার) ব্যবসা নেই।” ভাড়া ১৫-২০ হাজার টাকা বা আরও বেশি হওয়ার কথা কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এখন ব্যবসা নেই তো।”

ভাড়া না দেওয়ার বিষয়ে স্কুলের অভিযোগের কথা তুলে ধরতেই নুরুল হুদা মোল্লা দোকান বরাদ্দের ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়মের ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, “৪ লাখ টাকা ক্যাশ নিয়ে গেছে। এক লাখ টাকা কমিটি খেয়েছে। ৭ লাখ টাকার বেশি গেছে। দোকান বুঝিয়ে দিয়েছে ২০১৪ সালে। টাকা নিয়েছে ২০১১ সালের আগে। বুঝেন না, আরও দেওয়া লাগছে। বুঝেন না..?”

দোকানটি কার কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছেন, এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন, “আপনি এত কথা কেন বলতেছেন, আমাকে? কবরস্থান আছে যে, সেদিকে থাকে, আমি পরে কথা বলবো।” এই বলেই তিনি ফোন কেটে দেন।

এই কথোপকথন থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, নুরুল হুদা মোল্লা দোকান বরাদ্দের ক্ষেত্রে ব্যাপক ঘুষ লেনদেনের ব্যাপারে অবগত ছিলেন এবং নিজেও এই প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত ছিলেন।

রহমানিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের এই ঘটনায় স্পষ্ট, বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এবং সাবেক কাউন্সিলর মোবারক আলীর যোগসাজশে স্কুলের জমি দখল করে অবৈধ দোকান নির্মাণ এবং নামমাত্র মূল্যে বরাদ্দ দেওয়ার মাধ্যমে কোটি টাকার দুর্নীতি করা হয়েছে।

স্কুলের একজন শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, “আওয়ামী লীগের সাবেক কাউন্সিলর মোবারক আলী, দলটির নেতা এসকান্দার মিয়াসহ আরও কিছু নেতা মিলে বিদ্যালয়টিকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বানিয়ে ফেলেছে। সড়ক থেকে দেখলে স্কুলটাকে এখন একটা মার্কেট মনে হয়। অবৈধভাবে দোকান তৈরির ফলে রাস্তার পাশে ফুটপাত ছোট হয়ে গেছে। এসব বিষয়ে কর্তৃপক্ষের নজর দেওয়া উচিত।”

এই বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মো. শরীফ উদ্দিন বলেন, “রহমানিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের এই বিষয়টি নিয়ে কেউ লিখিত অভিযোগ করলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”