- একসময় আনোয়ারা-কর্ণফুলী চলতো সাবেক ভূমিমন্ত্রীর এপিএস রিদুয়ানুল করিম চৌধুরী সায়েমের নির্দেশে। তিনি ছিলেন একচ্ছত্র নেতার মতো, তার কথাই ছিল আইন। নেতারাও তার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন।
চট্টগ্রামের আনোয়ারা-কর্ণফুলীতে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের এপিএস রিদুয়ানুল করিম চৌধুরী সায়েমের ক্ষমতার দাপট এখন অতীত। সরকার পতনের পর হাজার কোটি টাকার সম্পদ গড়ে বিদেশে পাড়ি জমানো এই ব্যক্তি এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে। স্থানীয়দের অভিযোগ, পুলিশ ধরছে কেবল নামসর্বস্ব আওয়ামী লীগ কর্মীদের, কিন্তু সায়েম ও তার সহযোগীরা রয়ে গেছেন বহাল তবিয়তে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, আনোয়ারার হাইলধর ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর ছেলে রিদুয়ানুল করিম চৌধুরী সায়েম। দেড় দশক আগেও তার পরিবারের তেমন কোনো সম্পদ ছিল না। কিন্তু সাবেক ভূমিমন্ত্রীর এপিএস হওয়ার পর থেকেই তার ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করে। মন্ত্রীর ছত্রচ্ছায়ায় টেন্ডার বাণিজ্য, দলীয় পদ বিক্রি, মনোনয়ন বাণিজ্য, ঠিকাদারি, ঝুট ও মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণসহ নানা অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন তিনি।
অভিযোগ রয়েছে, চট্টগ্রাম-১৩ (আনোয়ারা-কর্ণফুলী) আসনে মন্ত্রীর চেয়েও বেশি ক্ষমতাধর ছিলেন সায়েম। দলীয় পোস্টারে শেখ মুজিব, শেখ হাসিনা ও সাইফুজ্জামানের ছবির পাশাপাশি তার ছবিও ব্যবহার করা হতো। মন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাকে প্রধান অতিথি করা হতো, এমনকি তার জন্য আলাদা চেয়ারের ব্যবস্থাও থাকতো। তার কথার অবাধ্য হলে আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদেরও পদ হারাতে হতো।
- সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের সাথে তার সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) রিদুয়ানুল করিম চৌধুরী সায়েম।
স্থানীয়দের দাবি, ক্ষমতার অপব্যবহার করে সায়েম হাজার কোটি টাকার মালিক বনেছেন। চট্টগ্রাম নগরে তার নামে-বেনামে একাধিক ফ্ল্যাট ও শোরুম রয়েছে। পটিয়া, আনোয়ারা, রাউজান ও কর্ণফুলীতে কিনেছেন কয়েক হাজার শতক জমি। থাইল্যান্ড ও দুবাইয়েও তার বাড়ি ও দোকান রয়েছে। অভিযোগ, অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করে এসব সম্পদ গড়েছেন তিনি।
আনোয়ারার কোরিয়ান ইপিজেডের ‘ইয়াংওয়ান’ কারখানায় নাজ এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২০১৭ সাল থেকে বছরে ৩০০ কোটি টাকার নির্মাণ ও পণ্য সরবরাহের কাজ করতেন সায়েম। কাগজে-কলমে এই প্রতিষ্ঠানের মালিক উপজেলা আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক জসিম উদ্দিন হলেও মূলত সায়েমই সব নিয়ন্ত্রণ করতেন।
একইভাবে, কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডে (কাফকো) কোনো টেন্ডার ছাড়াই সার লোড-আনলোডের কাজ বাগিয়ে নেন সায়েমের ঘনিষ্ঠজন মো. আলাউদ্দিন। আরএ এন্টারপ্রাইজের নামে বছরে পাঁচ কোটি টাকার এই কাজ ছাড়াও কাফকোতে তিন কোটি টাকার চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক সরবরাহের কাজও নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি।
রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানা ডিএপি ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডেও বছরে তিন কোটি টাকার চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক সরবরাহ এবং এক কোটি টাকার সার উৎপাদনের কাজ বাগিয়ে নিয়েছিলেন সায়েম। অভিযোগ রয়েছে, মনোনীত প্রতিষ্ঠানকে কাজ না দিলে কারখানার কার্যক্রমে বাধা দিতেন তিনি।
- আনোয়ারা উপজেলা আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক জসিম উদ্দীন (ছবিতে গোলাপী পাঞ্জাবি পরা ব্যক্তি) সায়েমের ব্যবসা-বাণিজ্য মূলত দেখাশোনা করেন।
এছাড়া, ইউনাইটেড পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি লিমিটেডে কেএম করপোরেশন এবং আজওয়াদ এন্টারপ্রাইজ নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নির্মাণ ও পণ্য সরবরাহের কাজ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। পরে এসব কাজ ১৫ শতাংশ লাভে সাব-ঠিকাদারদের কাছে বিক্রি করে দিতেন তিনি।
২০২২ সালে সায়েম, দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক রঘুপতি সেন মিলে পটিয়ায় প্রায় ২৮০ শতক জমি কেনেন। স্থানীয় দৈনিক পূর্বকোণে তাদের নামে জমির বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশিত হয়।
এছাড়া, আনোয়ারায় সিইউএফএল সার কারখানার পাশে কর্ণফুলী উপজেলা চেয়ারম্যান ফারুক চৌধুরী ও সায়েম মিলে প্রায় ৮০ শতক জমি কেনেন, যার বাজারমূল্য প্রায় আট কোটি টাকা। আনোয়ারা মা ও শিশু হাসপাতালের সামনে ৮০ শতক, ফকিরনিরহাট এলাকায় ৪০ শতক এবং বৈরাগ পুলিশ ফাঁড়ির পেছনে আরও প্রায় ৮০ শতক জমি কেনার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। পটিয়ার কাশিয়াইশ ইউনিয়নের নয়াহাটের পাশে নুরুল আলম সওদাগরের পরিত্যক্ত ইটভাটায় প্রায় ৩৬০ শতক জমি কিনেছেন তিনি। শ্বশুরবাড়ি রাউজানেও নামে-বেনামে তার অনেক জমি রয়েছে বলে জানা গেছে।
- এই ছবিতে সায়েমের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়িক পার্টনার, সহযোগী রয়েছেন।
সায়েমের ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম নগরের মিমি সুপার মার্কেটে তার একটি বিশাল শোরুম রয়েছে। এ ছাড়া, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিপরীতে এপিক ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পাশে নামে-বেনামে দুটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট রয়েছে তার। ঢাকায় গেলে তেজগাঁওয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পাশে একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে থাকতেন তিনি।
অভিযোগ রয়েছে, জিইসি মোড়ের এশিয়ান হাসপাতাল, গোলপাহাড়ের চট্টগ্রাম হেলথ পয়েন্ট, সার্সন রোডের নিউ হ্যাপি লাইফ হাসপাতালে নামে-বেনামে শেয়ার রয়েছে তার। ১০ কোটি টাকার বিনিময়ে ইউনি গ্যাসের চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার ডিলারশিপও নিয়েছেন তিনি। ইউসিবি ব্যাংকের কদমতলী শাখায় কর্মরত তার ভাই মঈনুল করিমের নামে সিঅ্যান্ডএফ লাইসেন্স করেছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, একসময় সায়েমের হাতেই ছিল আনোয়ারা-কর্ণফুলীর স্থানীয় রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ। অভিযোগ রয়েছে, সাবেক ভূমিমন্ত্রীর ছত্রচ্ছায়ায় তিনি দলীয় পদ, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন বাণিজ্য করতেন। টিআর-কাবিখা প্রকল্পে বরাদ্দপ্রাপ্তদের কাছ থেকে কমিশন নিতেন। আনোয়ারা ও কর্ণফুলীর অবৈধ তেল ও মাদক কারবারিদের কাছ থেকেও নিয়মিত মাসোহারা আদায় করতেন তিনি। তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করায় দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের কমিটি ভেঙে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।
- আনোয়ারা উপজেলা আওয়ামী যুবলীগের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রবীণ নেতাদের ছাপিয়ে মধ্যমণি ভূমিমন্ত্রীর এপিএস রিদুয়ানুল করিম চৌধুরী সায়েম। ছবিটিতে তার জন্য বরাদ্দকৃত বিশেষ আসন এবং অন্যদের ম্লান উপস্থিতি লক্ষণীয়।
আনোয়ারা উপজেলা যুবলীগ নেতা কফিল উদ্দিন বলেন, “সায়েম গত ১০ বছরে আনোয়ারা-কর্ণফুলীতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। অবৈধ ব্যবসা, টেন্ডার বাণিজ্য, মনোনয়ন বাণিজ্য করে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। সরকার পতনের পর তিনি থাইল্যান্ডে পালিয়ে গেছেন।” তিনি আরও অভিযোগ করেন, তৃণমূলের নেতাকর্মীদের বিভিন্ন মামলায় ফাঁসানো হলেও সায়েমের দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িতরা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন।
বৈরাগের আমিনুল হক ও চাতরী ইউনিয়নের মো. মহসিনসহ অনেকে অভিযোগ করেন, সায়েমের ঘনিষ্ঠজনদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে নিরীহ আওয়ামী লীগ কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
আনোয়ারা থানার ওসি মনির হোসেন জানান, বিগত সরকারের আমলে যারা চিহ্নিতভাবে মারামারি, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজিতে জড়িত ছিল, তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।
সায়েমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে এবং বাড়িতে গিয়েও তার সন্ধান মেলেনি।





