গরমে তীব্র লোডশেডিংয়ের আশঙ্কা, অর্থ সংকটে বিদ্যুৎ খাত


আসন্ন গ্রীষ্ম মৌসুম, বিশেষ করে এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে, দেশে তীব্র লোডশেডিংয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এই সময়ে বিদ্যুতের গড় দৈনিক চাহিদা প্রায় ১৮ হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ নিশ্চিত করতে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা প্রয়োজন, যা জোগাড় করা সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই বিপুল পরিমাণ অর্থ, যা মূলত বিদ্যুৎকেন্দ্র ও জ্বালানি আমদানির বকেয়া পরিশোধে ব্যবহৃত হবে, সংগ্রহ করা না গেলে গ্রীষ্মকালে দৈনিক ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হতে পারে, যা জনজীবনে চরম ভোগান্তি সৃষ্টি করবে।

বিদ্যুৎ খাত সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বাবদ বকেয়ার পরিমাণ প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এর সঙ্গে গ্রীষ্মকালে বিদ্যুৎ উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে শুধুমাত্র এলএনজি আমদানির জন্যই পেট্রোবাংলা সরকারের কাছে আরও ২৪ হাজার কোটি টাকা চেয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ ডলার প্রয়োজন। এই অর্থ সময়মতো পরিশোধ করা সম্ভব হলে লোডশেডিং পরিস্থিতি হয়তো সহনীয় পর্যায়ে রাখা যাবে, অন্যথায় জ্বালানি সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হবে এবং লোডশেডিং তীব্র আকার ধারণ করবে।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি), যারা বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনে বিতরণ সংস্থাগুলোর মাধ্যমে গ্রাহক পর্যায়ে সরবরাহ করে, তাদের কাছেই বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সংস্থাগুলোর বকেয়া জমেছে প্রায় ৩৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বেসরকারি কেন্দ্রগুলো পাবে ১২ হাজার কোটি, বাংলাদেশ-চীন যৌথ মালিকানার পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র পাবে ১০ হাজার ৩০০ কোটি এবং ভারতের আদানি গ্রুপ পাবে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা।

অন্যদিকে, জ্বালানি খাতে শুধু গ্যাস কেনা বাবদ বকেয়া রয়েছে ৭ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে শেভরনই পাবে প্রায় ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। বাকি অর্থ এলএনজি আমদানির বকেয়া। পাওনাদার প্রতিষ্ঠানগুলো বকেয়া আদায়ে বারবার তাগাদা দিলেও ডলার সংকটের কারণে অর্থ পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়।

দেশে বর্তমানে মোট বিদ্যুৎ গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি ৭৯ লাখ, যার সিংহভাগ (৩ কোটি ৬৭ লাখ) পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) অধীনে। গ্রীষ্মকালে এই বিপুল সংখ্যক গ্রাহকের চাহিদা মেটাতে প্রয়োজন হবে প্রায় ১৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ, যার মধ্যে শুধু আরইবির এলাকাতেই লাগবে সাড়ে ৯ থেকে ১০ হাজার মেগাওয়াট। যদিও দেশে স্থাপিত বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা (আমদানিসহ) প্রায় ২৬ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট, জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে সর্বোচ্চ ১৭ হাজার থেকে সাড়ে ১৭ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত উৎপাদন সম্ভব। কারণ, কিছু কেন্দ্র শুধু পিক আওয়ারে চালানোর জন্য সংরক্ষিত থাকে। উল্লেখ্য, দেশে এযাবৎকালের সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট (৩০ এপ্রিল, ২০২৪), যা চাহিদার তুলনায় এখনও কম।

গরম বাড়ার সাথে সাথে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বা এসির ব্যবহার বাড়ে, যা বিদ্যুতের চাহিদা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। পিডিবির প্রকৌশলীদের মতে, এসির পেছনেই প্রায় ৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের লোড রয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার এসির তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে না নামানোর নির্দেশনা দিয়েছে।

পিডিবির প্রকৌশলীরা জানাচ্ছেন, এবার গ্রীষ্মে ময়মনসিংহ অঞ্চলে পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ হতে পারে। এই অঞ্চলের প্রায় ৫০ লাখ গ্রাহকের জন্য পিক আওয়ারে প্রায় ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়, কিন্তু স্থানীয় ৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মোট স্থাপিত ক্ষমতা মাত্র ৬৪০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে দুটি সৌরকেন্দ্র সন্ধ্যায় বন্ধ হয়ে যায় এবং বাকিগুলোর বেশিরভাগই ব্যয়বহুল তেলভিত্তিক হওয়ায় পূর্ণ সক্ষমতায় চালানো সম্ভব হয় না। ফলে চাহিদার বড় অংশই বাইরে থেকে আনতে হয়। গত বছর এপ্রিলে এই অঞ্চলে প্রায় ৭০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং ছিল, এবার তা আরও বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

একইভাবে উত্তরবঙ্গের রংপুর অঞ্চলের অবস্থাও উদ্বেগজনক। এখানকার ৯৫০ মেগাওয়াট স্থাপিত ক্ষমতার মধ্যে ২৩০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ (যা সন্ধ্যায় বন্ধ থাকে) এবং ৫২৫ মেগাওয়াট বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র। কিন্তু কয়লা সংকট বা রক্ষণাবেক্ষণের কারণে বড়পুকুরিয়া কেন্দ্র প্রায়শই পূর্ণ সক্ষমতায় চলতে পারে না। ফলে এই অঞ্চলেও চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় তীব্র লোডশেডিংয়ের ইতিহাস রয়েছে এবং এবারও তার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সূত্রের খবর, লোডশেডিং ব্যবস্থাপনায় এবার ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, খুলনার মতো বড় শহরগুলোকে কিছুটা অগ্রাধিকার দেওয়া হতে পারে, যার ফলে গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিংয়ের মাত্রা বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম মনে করেন, শুধুমাত্র আমদানি করা জ্বালানির (কয়লা ও গ্যাস) ওপর নির্ভর করে লোডশেডিং পুরোপুরি দূর করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, “দেশীয় গ্যাসের সংস্থান না করতে পারলে লোডশেডিং মুক্ত করা যাবে না… বিদেশ থেকে কয়লা ও গ্যাস কিনে এনে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে লোডশেড মুক্ত করা যাবে না, কারণ সে সক্ষমতা আমাদের নেই।”

সব মিলিয়ে, প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা সংস্থান এবং জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা না গেলে আসন্ন গ্রীষ্মে দেশবাসীকে অসহনীয় লোডশেডিংয়ের ভোগান্তিতে পড়তে হতে পারে।