
মে দিবসের ছুটিতে খেলতে গিয়েছিল ওরা। গরমে একটু স্বস্তি পেতে আশ্রয় নিয়েছিল টিলার পাশে। কিন্তু সেই টিলাই ধসে পড়ে কেড়ে নিল চট্টগ্রামের আনোয়ারার দুই শিশুর প্রাণ। কোরিয়ান ইপিজেড (কেইপিজেড) সংলগ্ন বৈরাগ ইউনিয়নে বৃহস্পতিবার সকালের এই মর্মান্তিক ঘটনায় মো. রোহান (১১) ও মো. মিসবাহ (১১) নামের দুই শিশু ঘটনাস্থলেই মারা যায়। গুরুতর আহত অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে আরও দুই শিশু—মো. সিয়াম (১২) ও মো. সিফাত (১২)।
স্থানীয় লোকজন ও কেইপিজেড কর্তৃপক্ষের বিবরণে জানা যায়, ছুটির দিন হওয়ায় সকাল আনুমানিক সাড়ে ৯টা থেকে ১০টার দিকে বৈরাগ ইউনিয়নের পশ্চিমপাড়া ঈদগাহ সংলগ্ন কেইপিজেড এলাকার কাছে শিশুরা খেলছিল। গরম লাগায় তারা কাছাকাছি একটি টিলার নিচে ছায়ায় বসে। এ সময় হঠাৎ টিলার একাংশ ধসে পড়লে চার শিশু মাটিচাপা পড়ে। চিৎকার শুনে কেইপিজেডের নিরাপত্তা কর্মী ও আশপাশের লোকজন ছুটে এসে তাদের উদ্ধার করে আনোয়ারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান।
আনোয়ারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক পূজা মিত্র বলেন, হাসপাতালে আনার আগেই দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। আহত দুজনের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
আনোয়ারা থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) তৈয়বুর রহমান জানিয়েছেন, পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে এবং এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
‘উন্নয়নের’ পাশে মৃত্যুফাঁদ?
তবে এই মৃত্যুকে নিছক দুর্ঘটনা মানতে নারাজ স্থানীয় বাসিন্দারা। তাঁদের অভিযোগ, কেইপিজেড কর্তৃপক্ষের পাহাড় কাটার কারণেই এই ধসের ঘটনা ঘটেছে। যে টিলা ধসে পড়েছে, সেটি কেইপিজেডের কেটে রাখা পাহাড়েরই অংশ বলে দাবি তাঁদের।
ক্ষুব্ধ বাসিন্দা আবদুর রহমান বলেন, ‘আমাদের খেলার মাঠটা কেইপিজেড ভূমি উন্নয়ন নামে পাহাড় কেটে ভরাট করে ফেলেছে। খেলতে গিয়ে আজ ছেলেগুলো কাটা পাহাড়ের নিচে চাপা পড়ল। দুটো তাজা প্রাণ চলে গেল, এর দায় কে নেবে?’
বৈরাগের আরেক বাসিন্দা আবুল ফয়েস কেইপিজেডের পাহাড় কাটার প্রক্রিয়া নিয়ে গুরুতর অভিযোগ তুলে বলেন, ‘কেইপিজেড এমনভাবে নিচ থেকে পাহাড় কাটে যে বাইরে থেকে বোঝা যায় না। ৬০-৭০ ফুট পাহাড় কেটে হয়তো ১০-১২ ফুট করে ফেলে। এতে ওপরের অংশ ভারী হয়ে অল্প বৃষ্টিতেই ধসে পড়ে। পরিবেশের লোকজনও তাদের সঙ্গে জড়িত। মিডিয়ায় খবর হলেও তারা এসে নিয়ম মানার কথাই বলে। এখন বলে লাভ কী, আমাদের এভাবেই মরতে হচ্ছে।’
পুরোনো অভিযোগ, নতুন ট্র্যাজেডি
চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলায় প্রায় আড়াই হাজার একর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত কেইপিজেডের বিরুদ্ধে পাহাড় কাটার অভিযোগ বহু পুরোনো। একসময় সবুজ পাহাড়ে ঢাকা দেয়াং রেঞ্জের এই এলাকা শিল্পায়নের নামে গত এক দশকে অনেকটাই ন্যাড়া হয়ে গেছে বলে অভিযোগ পরিবেশকর্মী ও স্থানীয়দের।
২০২৪ সালের ১৩ আগস্ট একুশে পত্রিকায় “কেইপিজেডে ‘উন্নয়ন’ মানেই প্রকৃতি ধ্বংস, পাহাড় কাটা অব্যাহত” শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনেও কেইপিজেডের পাহাড় কাটার চিত্র উঠে এসেছিল। তখন কর্তৃপক্ষ টিলা কাটার কথা স্বীকার করলেও সেটিকে ‘উন্নয়ন কার্যক্রম’ হিসেবেই দাবি করেছিল। ২০১২ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর কেইপিজেডের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে পাহাড় কাটার অভিযোগে মামলাও করেছিল, পরে উচ্চ আদালত থেকেও পাহাড় কাটা বন্ধের নির্দেশ আসে। কিন্তু স্থানীয়দের অভিযোগ, পাহাড় কাটা বন্ধ হয়নি।
কেইপিজেডের ব্যাখ্যা
এদিকে, শিশুমৃত্যুর ঘটনায় কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ এক বিবৃতিতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছে। নিহতদের আত্মার মাগফেরাত কামনা ও আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে তারা।
তবে তাদের দাবি, দুর্ঘটনাটি ঘটেছে কেইপিজেড এলাকার সীমানার ভেতরে হলেও তাদের চলমান ভূমি উন্নয়ন এলাকা থেকে প্রায় ২০০ মিটার দূরে একটি পুরনো, পরিত্যক্ত ও বালুময় টিলায়। স্থানটিকে ‘শিয়াল ও শিয়াল গর্ভ সম্বলিত’ উল্লেখ করে তারা বোঝাতে চেয়েছে, এটি একটি অব্যবহৃত প্রাকৃতিক গঠন এবং তাদের সক্রিয় উন্নয়ন কাজের অংশ নয়।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, দুর্ঘটনার আগের দিন (৩০ এপ্রিল) আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সহকারী কমিশনার (ভূমি) এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কেইপিজেডের ভূমি উন্নয়ন এলাকা পরিদর্শন করেন এবং সেখানে কোনো ভূমি উন্নয়ন কাজ চলমান পাননি বা অনিয়ম দেখেননি।
উত্তর নেই দায় কার?
এই মৃত্যু আবারও সামনে এনেছে শিল্পায়নের নামে পরিবেশ ধ্বংস এবং তার পরিণতির ভয়াবহতাকে। স্থানীয়দের সরাসরি অভিযোগ আর কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যার—দুইয়ের ফারাক বিস্তর। এই প্রেক্ষাপটে দুটি শিশুর জীবনের বিনিময়ে প্রশ্ন উঠেছে, উন্নয়নের এই মডেল কতটা নিরাপদ? ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দায় নিরূপণ এখন জরুরি। এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে কি না, সেই উত্তরও খুঁজছে আনোয়ারাবাসী।
