আবারও রোহিঙ্গা স্রোত, নেপথ্যে আরাকান আর্মির ‘নৃশংসতা’

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সে দেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) ক্রমবর্ধমান দমন-পীড়ন ও জোরপূর্বক নিজেদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টার মুখে আবারও দলে দলে বাংলাদেশে ঢুকছে রোহিঙ্গারা। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি এবং কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তের বিভিন্ন দুর্গম পয়েন্ট দিয়ে রাতের অন্ধকারে তারা সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছে।

সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নজরদারি জোরদার করলেও দালালদের সহযোগিতায় দুর্গম পাহাড়ি পথ ব্যবহার করায় অনেক ক্ষেত্রেই তা ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। নতুন করে আসা এই রোহিঙ্গারা উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন শিবিরে আশ্রয় নেওয়া পুরনো প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে, যাদের বেশিরভাগই ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ভয়াবহ নির্যাতনের মুখে পালিয়ে এসেছিল।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, প্রতিদিন গড়ে ৩০ থেকে ৪০ জন রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আসছে। তাঁর দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত নতুন আসা ১ লাখ ১৮ হাজার রোহিঙ্গার বায়োমেট্রিক নিবন্ধন সম্পন্ন হয়েছে। আরও বহু রোহিঙ্গা নিবন্ধনের অপেক্ষায় রয়েছে, যাদের আপাতত খাদ্য সহায়তার টোকেন দেওয়া হয়েছে।

তবে এই টোকেন গ্রহণকারীদের মধ্যে কিছু পুরোনো রোহিঙ্গা ও স্থানীয় বাংলাদেশি ঢুকে পড়ায় মোট কত টোকেন বিতরণ করা হয়েছে, সে তথ্য জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেছে আরআরআরসি কার্যালয়।

কেন এই নতুন ঢল?

রাখাইনের একাধিক সূত্র ও পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, রাজ্যটির অধিকাংশ এলাকা বর্তমানে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। এই সশস্ত্র গোষ্ঠীটি এখন সাধারণ রোহিঙ্গাদের ওপর নানাভাবে নিপীড়ন চালাচ্ছে। মংডুর এক রোহিঙ্গা যুবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আরাকান আর্মি তরুণদের জোর করে তাদের সামরিক শাখায় যুক্ত করছে মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। এই বাধ্যতামূলক যোগদান এড়াতেই অনেকে জীবন বাঁচাতে পালাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমরা আরাকান আর্মির হয়ে দেশের জন্য লড়তে রাজি, যদি তারা আগে মিয়ানমারে আমাদের নাগরিকত্বের অধিকার স্বীকার করে নেয়।’

ওই যুবক আরও অভিযোগ করেন, ‘আরাকান আর্মির সদস্যরা প্রায়ই আমাদের বাড়িঘরে অভিযান চালায়। অনেককে জঙ্গি সংগঠন আরসার সদস্য সন্দেহে ধরে নিয়ে যায়, গ্রামবাসীকে ঘর থেকে বের করে খোলা আকাশের নিচে রাখে এবং যা পায়, লুট করে নিয়ে যায়।’

তাঁর ভাষ্যমতে, গত রোববারও মংডুর সিকদারপাড়া গ্রামে আরাকান আর্মি অভিযান চালিয়ে অন্তত ১০ জনকে আটক করে এবং রোহিঙ্গাদের পাঁচটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। সেই আগুনের ধোঁয়া টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ থেকেও দেখা গেছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জুবায়েরের অভিযোগ, আরাকান আর্মি রাখাইনে ‘পরিকল্পিতভাবে জাতিগত নিধন’ চালাচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘এখনও প্রায় সাড়ে তিন লাখ রোহিঙ্গা রাখাইনে আটকা পড়ে আছে, তাদের অনেকেই পালিয়ে আসার পথ খুঁজছে। যারা পালানোর চেষ্টা করে, আরাকান আর্মি তাদের কাছ থেকেও চাঁদা আদায় করে। এমনকি দৈনন্দিন কাজে গ্রামের বাইরে যেতে হলেও তাদের টোল দিতে হচ্ছে।’ এ ধরনের নিপীড়ন চলতে থাকলে বাংলাদেশে আবারও বড় ধরনের রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

বিজিবির তৎপরতা

টেকনাফে বিজিবি ব্যাটালিয়ন-২ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান জানান, নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগর বরাবর নজরদারি কঠোর থাকায় সংঘবদ্ধ মানব পাচারকারীরা এখন দুর্গম পাহাড়ি সীমান্ত ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঢোকাচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘পাচারকারীরা প্রায়ই তাদের কৌশল পাল্টাচ্ছে, তাই বিজিবিকেও ঘন ঘন তাদের প্রতিরোধ কৌশল বদলাতে হচ্ছে।’ সম্প্রতি অবৈধভাবে প্রবেশের চেষ্টাকালে অনেক রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

রোহিঙ্গা শিবিরের নেতারাও আরাকান আর্মির ক্রমবর্ধমান নিপীড়নের কারণে সামনের দিনগুলোতে নতুন করে আরও বড় পরিসরে রোহিঙ্গা ঢলের আশঙ্কা করছেন।