দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগের মধ্যেই পুলিশের হাত থেকে অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র প্রত্যাহার করে লাঠি বা শটগান নিয়ে দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা জারি হয়েছে। এমন এক সময়ে এই সিদ্ধান্ত এলো, যখন পুলিশেরই লুট হওয়া এসএমজি টি-৫৬, স্নাইপার রাইফেলের মতো ১ হাজার ৩৬৯টি মারাত্মক অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি এবং সেগুলো অপরাধীদের হাতে চলে গেছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। পাশাপাশি, ব্যক্তি পর্যায়ে লাইসেন্স করা অন্তত ৬ হাজার ২০৪টি আগ্নেয়াস্ত্রও পুলিশের নির্দেশনা সত্ত্বেও থানায় জমা পড়েনি, যা এখন পুলিশের দৃষ্টিতে অবৈধ। এই পরিস্থিতিতে মারণাস্ত্র জমা দিয়ে সীমিত অস্ত্রে কর্তব্য পালনের নির্দেশনায় চরম উদ্বেগ ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে গভীর শঙ্কা তৈরি হয়েছে পুলিশের অনেক সদস্যের মধ্যে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এতে বাহিনীর মনোবল দুর্বল হওয়ার পাশাপাশি অপরাধ দমনেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
পুলিশকে মারণাস্ত্রবিহীন করার এই বিতর্কিত সিদ্ধান্ত জানানোর মাত্র দুদিনের মাথায় গতকাল স্পেশাল সিকিউরিটি অ্যান্ড প্রটেকশন ব্যাটালিয়ন-২ (এসপিবিএন-২) তাদের নতুন অফিসের গার্ড ডিউটি সংক্রান্ত এক নির্দেশনায় জানিয়েছে, এএসআই পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের ডিউটির সময় হাতিয়ার হিসেবে লাঠি নিয়ে সতর্ক অবস্থানে থাকতে হবে। কনস্টেবলদের জন্যও একই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যেখানে পূর্বে তারা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করতেন। এই সিদ্ধান্তের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে, যদিও বাহিনীর সদস্যরা প্রকাশ্যে মুখ খুলছেন না। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পুলিশ সদস্য জানিয়েছেন, এমন সিদ্ধান্ত তাদের মনোবল দুর্বল করার পাশাপাশি ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। মারণাস্ত্র ছাড়া দাগি ও সশস্ত্র অপরাধীদের ধরতে বিশেষ অভিযানে যাওয়ার ক্ষেত্রে তারা জীবনের ঝুঁকি দেখছেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুসারেই, গত বছরের ৫ আগস্ট ও তার পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সহিংস ঘটনায় পুলিশের মোট ৫ হাজার ৭৫৩টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং প্রায় সাড়ে ছয় লক্ষাধিক গোলাবারুদ লুট হয়েছিল। এর মধ্যে এখনও ১ হাজার ৩৬৯টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ২ লাখ ৫১ হাজার ৮২৬টি গোলাবারুদ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। উদ্ধার না হওয়া এই মারণাস্ত্রের তালিকায় রয়েছে ২৯৬টি চাইনিজ রাইফেল, আটটি বিডি রাইফেল, ৬০টি চাইনিজ এসএমজি, ১১টি এলএমজি, ৫৪টি চাইনিজ পিস্তল, ৬৫৩টি ৯ বোরের পিস্তল, একটি এসএমজি, ৬৫৩টি ১২ বোরের শটগান, ১১৭টি সিঙ্গেল গ্যাস গান, পাঁচটি ৩৮ মিমি টিয়ার গ্যাস লঞ্চার এবং দুটি সিগন্যাল পিস্তল। এমনকি, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর গণভবন থেকে এসএসএফের (স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স) ৩২টি অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রও খোয়া যায়, যার মধ্যে এসএমজি টি-৫৬, অত্যাধুনিক অ্যাসল্ট রাইফেল, স্নাইপার রাইফেল, ফ্ল্যাশ ব্যাং গ্রেনেড, অ্যান্টি ড্রোন গান, অ্যান্টি ড্রোন সিস্টেম ও বেতার যোগাযোগের ডিভাইসও ছিল।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, “৫ আগস্ট ও তার পরবর্তী সময়ে পুলিশের ৫ হাজার ৭৫৩টি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র লুট হয়। পরবর্তী সময়ে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে ৪ হাজার ৩৮৪টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। ১ হাজার ৩৬৯টি এখনো উদ্ধার হয়নি। এসব অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।”
কিন্তু মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের অনেকের মতেই, অপরাধীরা বর্তমানে অনেক বেশি বেপরোয়া এবং তাদের কাছে বিভিন্ন ধরনের অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে। এমনকি সাধারণ পরিস্থিতিতে, যেমন মোটরসাইকেলের কাগজ যাচাই করার সময়ও পুলিশ সদস্যরা হামলার শিকার হচ্ছেন। এমন বাস্তবতায় অস্ত্র ছাড়া দাগি অপরাধীদের ধরতে বিশেষ অভিযানে যাওয়াটা তাদের কাছে আত্মহত্যার শামিল। তারা মনে করছেন, পুলিশের ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টার মুহূর্তে মারণাস্ত্র জমা দেয়ার এই সিদ্ধান্ত বাহিনীর সদস্যদের মনোবল আরও দুর্বল করে দেবে এবং তাদের কাজের ক্ষেত্রে ঝুঁকি বহুগুণে বাড়িয়ে তুলবে। তাদের যুক্তি, পুলিশের অস্ত্র আত্মরক্ষা এবং অপরাধীকে নিয়ন্ত্রণের জন্য অপরিহার্য, এবং এর ব্যবহারবিধি আইনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে।
এ বিষয়ে মানবাধিকার কর্মী ও পুলিশ সংস্কার কমিশনের সাবেক সদস্য এএসএম নাসিরউদ্দিন বলেন, “পুলিশ হবে জনগণের বন্ধু। তাদের কাছে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের অস্ত্র থাকা মানেই মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। যেকোনো পরিস্থিতি, হোক সেটা মব বা রাজনৈতিক, নিয়ন্ত্রণের জন্য কয়েকটি ধাপ রয়েছে। সেগুলো অনুসরণ করেই পুলিশকে কাজ করতে হবে। বিগত সরকার যেমন পুলিশকে দিয়ে নিরপরাধ মানুষের ওপর গুলি চালিয়েছে, সেই সুযোগ যেন আর কেউ না পায়। আর এ ধরনের সংস্কারমূলক সিদ্ধান্ত কোনো দলীয় সরকারের পক্ষে নেওয়া কঠিন।”
তবে বাহিনীর অভ্যন্তরে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা থাকলেও কেউই প্রকাশ্যে নাম প্রকাশ করে কথা বলতে রাজি হচ্ছেন না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের এক উপপরিদর্শক (এসআই) পদমর্যাদার কর্মকর্তা বলেন, “বেশির ভাগ পুলিশ সদস্যই এই সিদ্ধান্তের বিপক্ষে। পুলিশের কাছে যদি অস্ত্র না থাকে, তাহলে তারা কি নিছক লাঠি হাতে নিয়ে ডিউটি করবে? এখন অস্ত্র থাকার পরও যেখানে অপরাধীরা পুলিশকে তোয়াক্কা করছে না, সেখানে অস্ত্র কেড়ে নিলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে? অস্ত্র কেড়ে নিলে সদস্যদের মনোবল যে দুর্বল হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অনেকে ঝুঁকি নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালনে আগ্রহও হারিয়ে ফেলতে পারেন।”
একই সুরে উদ্বেগ প্রকাশ করে সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) পদমর্যাদার আরেক কর্মকর্তা বলেন, “পুলিশেরও আত্মরক্ষার অধিকার আছে। দুর্ধর্ষ আসামি ধরতে গিয়ে তাদের জীবন প্রায়শই বিপন্ন হয়। এমন পরিস্থিতিতে এই সিদ্ধান্ত খুবই উদ্বেগজনক। পুলিশের নিজের কাছেই যদি আত্মরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত অস্ত্র না থাকে, তাহলে তারা অস্ত্রধারী আসামিদের গ্রেফতার করবে কীভাবে? আর কোনো অভিযানে গিয়ে আত্মরক্ষার প্রয়োজন পড়লে তারা কী করবে?”
এই জটিল পরিস্থিতি নিয়ে সাবেক আইজিপি নুর মোহাম্মদ বলেন, “পুলিশ অনেক আগে থেকেই এলএমজি, এসএমজির মতো অস্ত্র ব্যবহার করে আসছে। ২০০৫ সালের দিকে রাজশাহী ও খুলনা অঞ্চলে চরমপন্থীদের সঙ্গে পুলিশের নিয়মিত গোলাগুলি হতো। জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গেও পুলিশের সশস্ত্র সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এখনো অপরাধীদের হাতে ভারী অস্ত্র রয়েছে। আবার এটাও ঠিক যে, বিগত সময়ে পুলিশ রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে এবং যখন-তখন গুলি ছুড়তে বাধ্য হয়েছে, যা পুলিশের মধ্যে এক ধরনের ‘ট্রিগার হ্যাপিনেস’ তৈরি করেছে। এমন পরিস্থিতিতে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের কেবল শটগান নিয়ে মোকাবেলা করা পুলিশের জন্য একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে। তবে আমি মনে করি, সরকার যেহেতু একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, অবশ্যই অনেক চিন্তাভাবনা করেই নিয়েছে। বিকল্প কোনো পন্থা নিশ্চয়ই তাদের পরিকল্পনায় রয়েছে।”
এদিকে, পুলিশের অস্ত্র নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তটি যথেষ্ট জেনে-বুঝেই নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম। গতকাল সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, “যে অস্ত্রের গুলিতে নিশ্চিত মৃত্যু হয়, যেগুলো থেকে বুলেট নির্গত হয়, সেগুলো আমরা এড়িয়ে যেতে চাই। তবে সবার সঙ্গে আলোচনা করেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। নীতিগতভাবে আমরা মনে করি, পুলিশ ‘কিলার ফোর্স’ হতে পারে না। আমার কাছে বড়জোর শটগান থাকবে, এটাই সবার স্বাভাবিক প্রত্যাশা। তবে যেসব বিশেষ জায়গায় ঝুঁকি থাকে বা কোনো প্রকার বিদ্রোহের আশঙ্কা থাকে, সেখানে অবশ্য এসব নিয়ম মানা খুব কঠিন হবে। সেক্ষেত্রে বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনা করা হবে।”
আইজিপির এই বক্তব্যে আশ্বাসের সুর থাকলেও মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের উদ্বেগ ও শঙ্কা তাতে কতটা প্রশমিত হবে, এবং এই সিদ্ধান্ত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় কতটা সহায়ক হবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার এবং পুলিশকে সীমিত অস্ত্রে মাঠে নামানোর যুগপৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সরকারের জন্য সহজ হবে না।