কালুরঘাট সেতুর ব্যয়: চোখ কপালে তোলা অঙ্ক, উত্তর দেবে কে?

চট্টগ্রামের মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন কালুরঘাট সেতু। একটি নতুন, আধুনিক রেল কাম সড়ক সেতুর জন্য আমরা দশকের পর দশক ধরে অপেক্ষা করছি। অবশেষে গত বুধবার (১৪ মে) সেই স্বপ্নের সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হয়েছে। খবরটি আনন্দের, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই আনন্দের সঙ্গে একরাশ উদ্বেগ আর প্রশ্নও যে আমাদের কাঁধে চেপে বসেছে! মাত্র ৭০০ মিটার, অর্থাৎ এক কিলোমিটারেরও কম দৈর্ঘ্যের একটি মূল সেতু। আর এর জন্য নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ১১ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা! হ্যাঁ, আপনি ঠিকই পড়ছেন। চোখ কপালে ওঠার মতোই অঙ্ক বটে।

এই বিপুল পরিমাণ অর্থ কোত্থেকে আসবে? নিশ্চয়ই আমার, আপনার, এদেশের সাধারণ মানুষের করের টাকা থেকে। উন্নয়নের জন্য অর্থ খরচ হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই খরচ যদি আকাশছোঁয়া, অস্বাভাবিক এবং প্রশ্নের জন্ম দেওয়া হয়, তখন চুপ করে থাকা যায় না। বিশেষ করে যখন আমরা দেখি, এই সেতুর কিলোমিটারপ্রতি নির্মাণ ব্যয় পদ্মা সেতুর খরচের কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছে। পদ্মা সেতু একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ, তার প্রকৌশলগত জটিলতা অনেক। সেই তুলনায় কালুরঘাটের এই সেতুটিকে তুলনামূলক ছোটই বলতে হবে। তবুও খরচের এমন বহর কেন?

টাকা যাচ্ছে কোথায়? রহস্যটা কী?

কর্তৃপক্ষ বলছে, মূল সেতু ৭০০ মিটার হলেও এর সঙ্গে আরও অনেক কিছু থাকছে। দুই প্রান্তে ৬ দশমিক ২ কিলোমিটার রেল ভায়াডাক্ট বা উড়ালপথ হবে। আরও ২ দশমিক ৪ কিলোমিটার হবে সড়ক ভায়াডাক্ট। রেলপথের জন্য ৪ দশমিক ৫৪ কিলোমিটার বাঁধও তৈরি করতে হবে। আর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে ১৪১ একরের বেশি। রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এসব কারণেই নাকি সেতুর নির্মাণ ব্যয় এত বেশি।

আমরা সাধারণ মানুষ, প্রকৌশলের এত জটিল হিসাব হয়তো বুঝি না। কিন্তু কিছু সাধারণ তুলনা তো আমরা করতেই পারি। এই প্রকল্পের সবচেয়ে ব্যয়বহুল অংশ ধরা হচ্ছে ভায়াডাক্ট নির্মাণ। ডিপিপি বলছে, ৬ দশমিক ২ কিলোমিটার দীর্ঘ রেল ভায়াডাক্ট তৈরিতে খরচ হবে ৪ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতি কিলোমিটার ভায়াডাক্টের জন্য খরচ পড়ছে প্রায় ৩৩৩ কোটি টাকা। অথচ পদ্মা সেতুর জন্য যে সিঙ্গেল লাইনের রেল ভায়াডাক্ট তৈরি হয়েছে, সেখানে কিলোমিটারপ্রতি খরচ হয়েছে ২৬৩ কোটি টাকা। কালুরঘাটে না হয় ডাবল রেললাইন হচ্ছে, তাই বলে খরচ এত বেশি লাফাবে?

আরও একটি বিষয় আমাদের বিস্মিত করেছে। কালুরঘাট সেতুর ভায়াডাক্টের জন্য নেভিগেশনাল ক্লিয়ারেন্স বা নৌযান চলাচলের জন্য উচ্চতা ধরা হয়েছে ১২ দশমিক ২ মিটার। আর পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে এটি ছিল ১৮ মিটার। অর্থাৎ, পদ্মার চেয়ে কালুরঘাটের ভায়াডাক্ট কম উঁচু হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, কম উঁচু ভায়াডাক্টে খরচ বেশি হয় কীভাবে? অবকাঠামো বিশেষজ্ঞরা তো বলছেন, ভায়াডাক্টের উচ্চতা নির্মাণ ব্যয়ের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

সবচেয়ে বিস্ময়কর তথ্য হলো, আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে এর চেয়ে অনেক কম খরচে এমন ভায়াডাক্ট তৈরি হচ্ছে। সেখানে ‘কাটনি গ্রেড সেপারেটর প্রজেক্ট’-এর আওতায় যে দীর্ঘতম রেল ভায়াডাক্ট তৈরি হচ্ছে, তাতে কিলোমিটারপ্রতি খরচ পড়ছে মাত্র ৫২ কোটি টাকা! কোথায় ৫২ কোটি আর কোথায় আমাদের ৩৩৩ কোটি টাকা! এ যেন আকাশ আর পাতাল পার্থক্য। আমাদের দেশে টাকা কি এতই সস্তা হয়ে গেল? নাকি আমাদের প্রকৌশলীরা এমন কোনো বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন, যা পৃথিবীর আর কোথাও নেই এবং যার জন্য এত বিপুল খরচ অপরিহার্য? উত্তরগুলো আমাদের জানা দরকার।

ব্যয়বৃদ্ধির রকেটগতি ও কিছু প্রশ্ন

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা অবশ্য বলছেন, সেতুর দৈর্ঘ্য কম হলেও ভায়াডাক্ট, বাঁধ এসব কারণেই খরচ বেশি। তিনি আরও জানিয়েছেন, অর্থায়নকারী সংস্থা ইডিসিএফ-এর প্রাথমিক সমীক্ষার ভিত্তিতে এই ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে। আর এটি নাকি চূড়ান্ত ব্যয় নয়, দরপত্র আহ্বানের পর নির্ধারিত হবে। এই কথাগুলো আমাদের কতটা আশ্বস্ত করতে পারছে? অতীতে অনেক প্রকল্পেই এমন প্রাথমিক ব্যয় দেখানোর পর চূড়ান্ত ব্যয় আরও কয়েক দফা বাড়তে দেখা গেছে।

আরেকটি বিষয় আমাদের গভীরভাবে ভাবাচ্ছে। কালুরঘাটে এই নতুন সেতু নির্মাণের উদ্যোগ তো আজকের নয়। এক দশকেরও বেশি সময় আগে এর যাত্রা শুরু। ২০১৪ সালে তৎকালীন সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ব্রিটিশ আমলে তৈরি পুরোনো সেতুটির বদলে নতুন সেতু হবে। সেই মোতাবেক ২০১৮ সালে একটি ডিপিপি বা উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছিল। তখন এর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা। সেই সেতুতে অবশ্য সিঙ্গেল রেললাইন ছিল। আর এখন, ২০২৪ সালে যে নতুন ডিপিপি তৈরি হলো, তাতে ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৫৬০ কোটি টাকায়! মাত্র ছয় বছরের ব্যবধানে ব্যয় বাড়ল প্রায় দশ গুণ!

উপদেষ্টা মহোদয় বলছেন, ২০১৮ সালের ডিপিপির চেয়ে ২০২৪ সালের ডিপিপিতে সেতুর উচ্চতা বাড়ানো হয়েছে নেভিগেশনাল ক্লিয়ারেন্স ঠিক রাখার জন্য। এর সঙ্গে কাজের পরিধি বেড়েছে, সড়ক ও রেলপথের দৈর্ঘ্য বেড়েছে, সিঙ্গেল লাইনের বদলে ডাবল রেললাইন হয়েছে, নতুন করে ভায়াডাক্ট যুক্ত হয়েছে। এসব কারণেই নাকি ব্যয় এতটা বেড়েছে। আমরা মানছি, কাজের পরিধি বাড়লে ব্যয় বাড়বে। কিন্তু দশ গুণ বৃদ্ধি কি স্বাভাবিক? এর মধ্যে কি কোনো অস্বচ্ছতা নেই? কোনো অপচয়ের সুযোগ কি তৈরি হচ্ছে না?

চট্টগ্রামের মানুষ হিসেবে আমরা জানি, এই কালুরঘাট সেতু আমাদের জন্য কতটা জরুরি। দক্ষিণ চট্টগ্রামসহ কক্সবাজারের সঙ্গে যোগাযোগের লাইফলাইন এটি। ব্যবসা-বাণিজ্য, পর্যটন, সাধারণ মানুষের যাতায়াত – সবকিছুতেই এর গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু এই জরুরি প্রয়োজনের সুযোগ নিয়ে কেউ যদি জনগণের অর্থ নয়ছয় করার পাঁয়তারা করে, সেটা মেনে নেওয়া যায় না।

এখানে আরও একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। এই সেতুর সমীক্ষা ও উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরি হয়েছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। আর সেটি অনুমোদন দিয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। তার মানে, প্রকল্প পরিকল্পনা ও অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় একটি ধারাবাহিকতা রয়েছে। এখানে কোনো সরকারের একক দায় চাপানো উদ্দেশ্য নয়, কিন্তু জনগণের টাকার সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার দায় প্রতিটি সরকারেরই। অতীতেও বিভিন্ন প্রকল্পে মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় নিয়ে অবকাঠামো বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন। পদ্মা সেতু ও যমুনা রেল সেতুর নির্মাণ ব্যয় নিয়েও এমন অভিযোগ ছিল। সেই একই পথে কি কালুরঘাট সেতুও হাঁটছে?

এখনও কি সুযোগ আছে?

তবে সব আঁধারের মধ্যেও এক চিলতে আলোর রেখা দেখিয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সামছুল হকের মতো বিশেষজ্ঞরা। তিনি মনে করেন, যেহেতু এখনও সেতুর নির্মাণকাজের জন্য দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি, তাই খরচ কমানোর সুযোগ রয়েছে। প্রকল্পটি যেহেতু সরকার-টু-সরকার (জিটুজি) পদ্ধতিতে হচ্ছে না, তাই একটি প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র প্রক্রিয়ার আশা করাই যায়। যদি ডিপিপিতে প্রকল্প ব্যয় বেশি অনুমান করা হয়েও থাকে, স্বচ্ছ ও প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে তা কমে আসতে পারে। অধ্যাপক হক প্রকল্পের ক্রয় কার্যক্রমে সর্বোচ্চ দক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার যে আহ্বান জানিয়েছেন, আমরা তার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত।

একুশে পত্রিকা চট্টগ্রামের গণমানুষের কথা বলে। আমরাও চাই, কালুরঘাটে একটি আধুনিক ও টেকসই সেতু নির্মিত হোক। এই সেতু চট্টগ্রামের অর্থনীতিতে নতুন গতি আনবে, মানুষের জীবনযাত্রা সহজ করবে। কিন্তু সেই উন্নয়ন হতে হবে স্বচ্ছ, সাশ্রয়ী এবং জনস্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে। জনগণের টাকায় এলাহি কারবার আমরা দেখতে চাই না।

আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে এবং সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানাই, কালুরঘাট সেতুর এই বিপুল ব্যয়বরাদ্দ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করা হোক। প্রতিটি টাকার হিসাব জনগণের সামনে পরিষ্কার করা হোক। দরপত্র প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে নির্মাণকাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হোক। প্রয়োজনে স্বাধীন বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে পুরো বিষয়টি তদন্ত করা যেতে পারে।

মনে রাখতে হবে, একটি সেতু শুধু ইট-সিমেন্টের কাঠামো নয়। এটি জনগণের আস্থা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। সেই আস্থায় যেন কোনোভাবেই চিড় না ধরে। কালুরঘাট সেতু যেন দুর্নীতির নতুন আখড়া না হয়ে, সত্যিই চট্টগ্রামের উন্নয়নের মাইলফলক হয়ে ওঠে – এটাই আমাদের একান্ত চাওয়া। আমরা তাকিয়ে রইলাম কর্তৃপক্ষের বিচক্ষণ সিদ্ধান্তের দিকে। কারণ, উন্নয়নের নামে এমন পুকুরচুরির আয়োজন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। জনগণের টাকার প্রতিটি পয়সার হিসাব দেওয়ার দায় আপনাদেরই।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।