৬০০ প্রাণের রক্তে রাঙা দেয়াঙ পাহাড়


সবুজে মোড়ানো পাহাড়ঘেরা এক নির্জন প্রান্তর—চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার বড়উঠান ইউনিয়নের দেয়াঙ পাহাড়। বন্দর নগরী চট্টগ্রাম থেকে শাহ আমানত সেতু পার হয়ে ১৫ কিলোমিটার গেলেই দেখা মেলে এ দেয়াঙ পাহাড়ের। দৃশ্যত পাহাড় হলেও এটি শুধু পাহাড় নয়, এখানে দাঁড়িয়ে আছে পাঁচশ’ বছরের ইতিহাস। তাই এ পাহাড়ে পা রাখলেই মনে হয়—এই নীরবতা যেন কিছু বলছে, কিছু ইতিহাস আজও বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। এখানেই অবস্থিত মরিয়ম আশ্রম ও পূর্ববঙ্গের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের প্রথম গির্জা। যা এ সম্প্রদায়ের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান।

পাহাড়ি পথ ধরে ওপরে উঠলে চোখে পড়ে যিশুমাতা মরিয়মের একটি কাচঘেরা প্রতিকৃতি। চারপাশে ছড়িয়ে আছে ছোট ছোট প্রার্থনাকক্ষ, ধ্যানঘর আর পাথরের পথ। পরিবেশ এতটাই শান্ত যে মনে হয় সময় এখানে থেমে আছে।

ইতিহাস বলছে, দেয়াঙ আশ্রমের ইতিহাস প্রায় পাঁচ শতাব্দী পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। ১৫১৮ সালে চট্টগ্রামে আসেন পর্তুগিজ বণিকেরা, আর ১৫৩৭ সালের দিকে তাঁরা দেয়াঙ এলাকায় গড়ে তোলেন একটি খ্রিস্টান পল্লি। তখন থেকেই শুরু হয় একটি দীর্ঘ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অধ্যায়ের।

১৫৯৮ সালে দক্ষিণ ভারতের কচিন অঞ্চল থেকে মিশনারি ও যাজকেরা আগমন শুরু করেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জেসুইট ধর্মযাজক ফাদার ফ্রান্সেসকো ফার্নান্দেজ, যিনি ১৫৯৯ সালে এই পাহাড়েই নির্মাণ করেন চট্টগ্রামের প্রথম গির্জা। এরপর ১৬০০ সালে তিনি বান্ডেল রোড ও জামালখান এলাকায় গড়ে তোলেন আরও দুটি গির্জা।

আধুনিক মরিয়ম আশ্রমের ভিত্তি স্থাপন করেন ব্রাদার ফ্লেভিয়ান লাপ্লান্ত। ১৯৩২ সালের ১৭ অক্টোবর কানাডা থেকে চট্টগ্রামে এসে তিনি দেয়াঙে বসবাস শুরু করেন এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের আর্থসামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাঁর হাত ধরেই গড়ে ওঠে এই আশ্রম, আশপাশে গড়ে ওঠে স্কুল, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, ছাত্রাবাস এবং প্রার্থনার জায়গা।

সরেজমিন দেখা গেছে, এই পাহাড়েই রয়েছে ব্রাদার ফ্লেভিয়ান লাপ্লান্তর স্মৃতিস্তম্ভ, যা আজও দর্শনার্থীদের মনে জাগিয়ে তোলে কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা। আশ্রমের পাশে জোসেফ পাড়া ও মরিয়ম পাড়ায় এখনও বাস করছেন প্রায় ২৩টি পর্তুগিজ ও ডি রোজা বংশোদ্ভূত পরিবার, যাঁদের পূর্বপুরুষেরা এই অঞ্চলের খ্রিস্টান ঐতিহ্য বয়ে এনেছেন।

এখানে ১৯৪৬ সালে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয় মরিয়ম আশ্রম উচ্চবিদ্যালয়, যেখানে এখন পড়ছে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আয়োজন করা হয় মা মরিয়মের তীর্থ-উৎসব, যেখানে সারা দেশের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ অংশ নেন।

১৯৭৬ সালের ২৬ ডিসেম্বর তৎকালীন বিশপ জোয়াকিম রোজারিও এই পাহাড়কে তীর্থস্থান হিসেবে ঘোষণা দেন। তবে দেয়াঙের ইতিহাস শুধু উন্নয়ন আর প্রার্থনায় থেমে নেই—১৬২৪ সালে ফাদার ফার্নান্দেজ আরাকানি সৈন্যদের হাতে নিহত হন, আর তাঁদের হাতে প্রাণ হারান প্রায় ৬০০ পর্তুগিজ নারী, পুরুষ ও শিশু। আজকের এই ক্যাথিড্রাল গির্জা তাঁর সমাধির ওপরই নির্মিত।

এই আশ্রম শুধু ধর্মীয় সাধনার কেন্দ্র নয়, এটি হয়ে উঠেছে ইতিহাস, স্মৃতি ও সহনশীলতার জীবন্ত প্রতীক। প্রতিদিন শত শত মানুষ এখানে আসেন; কেউ প্রকৃতির প্রশান্তি খুঁজতে, কেউ ইতিহাসের স্পর্শ পেতে। বলা যায়, দেয়াঙ যেন এক নীরব শিক্ষক, যে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—মাটি, মানুষ আর বিশ্বাস মিলেই গড়ে ওঠে সত্যিকারের তীর্থভূমি। বর্তমানে এই আশ্রমের পরিচালনায় রয়েছেন ৯৫ বছর বয়সী ব্রাদার লরেন্স ডায়েস। যিনি ২০০০ সাল থেকে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

জানতে চাইলে লরেন্স ডায়েস একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা যেখানে আছি এটি হচ্ছে মরিয়ম আশ্রম। এ তীর্থস্থানে ঈসা নবীর মা, যাকে আমরা মা মারিয়া বলি। আমরা খ্রিস্টান সম্প্রদায় তাঁকে ভক্তি করি। এ কারণে এটি একটি ধ্যান সাধনার জায়গা। মরিয়মের উপর ভক্তি বাড়ানোর একটি জায়গা। এখানে বছরে একটি তীর্থ-উৎসব হয়। এখানে আমার সাথে আরও একজন ফাদার আছেন। আমাদের কাছে একটি বিশ্বাস আছে। মা মারিয়ার উপর বিশ্বাস। বিশ্বাসের কারণেই আমাদের এ যাত্রা।’