আমাদের জ্ঞান কত ক্ষুদ্র?


বিখ্যাত লেখক মোহাম্মদ আমিনুল হকের একটি দারুণ গল্প আছে। এই গল্পটি আমাদের একটি বড় সত্যি মনে করিয়ে দেয়। গল্পটি হলো একটি মহাসাগরীয় ব্যাঙকে নিয়ে। সেই ব্যাঙটি লাফাতে লাফাতে এসে পড়েছিল একটি কুয়ার ভেতরে। কুয়ায় আগে থেকেই একটি ব্যাঙ থাকত। নতুন আসা ব্যাঙটিকে দেখে কুয়ার ব্যাঙটি অবাক হলো। সে মহাসাগরীয় ব্যাঙকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কে? কোথা থেকে এসেছ? কেনই বা আমার কুয়ায় এসেছ?

মহাসাগরীয় ব্যাঙটি উত্তরে বলল, সে মহাসাগরের পাড়ে ছিল। একটি খাবারের পেছনে ছুটতে ছুটতে ভুল করে এই কুয়ায় এসে পড়েছে। একথা শুনে কুয়ার ব্যাঙটি আরও অবাক হলো। সে জিজ্ঞেস করল, মহাসাগর সেটা আবার কী? মহাসাগরীয় ব্যাঙ বলল, মহাসাগর হলো বিশাল এক জলরাশি।

তখন কুয়ার ব্যাঙটি একটু লাফ দিয়ে বলল, এই জলরাশি কি আমার এই কুয়ার চেয়ে বড় হবে? মহাসাগরীয় ব্যাঙ হেসে বলল, না ভাই, এটা অনেক বড়। কুয়ার ব্যাঙটি যেন বিশ্বাস করতে পারল না। সে আবার জিজ্ঞেস করল, এটা কি আমার পাশের ওই পুকুরটার সমান হবে? মহাসাগরীয় ব্যাঙ আবারও বলল, না ভাই, এটা আরও অনেক বড়। কুয়ার ব্যাঙটি নাছোড়বান্দা। সে আবার জানতে চাইল, তাহলে কি এটা শীতলক্ষ্যা নদীর চেয়ে বড় হবে?

মহাসাগরীয় ব্যাঙ বোঝানোর চেষ্টা করল। সে বলল, না ভাই, মহাসাগর অনেক অনেক বড়। এত বড় যে এর কোনো কুল কিনারা দেখা যায় না। শুধু পানি আর পানি। একথা শুনে কুয়ার ব্যাঙটি রেগে গেল। তার ছোট জগতে মহাসাগরের মতো বিশাল কিছুর ধারণা ছিল না। সে ভাবল, মহাসাগরীয় ব্যাঙটি আবোল তাবোল কথা বলছে। তার মতে, তার কুয়াই সবচেয়ে বড় জলরাশি। সে রাগ করে বলল, আবোল তাবোল কথা বলার আর জায়গা পেলে না?

এই গল্পটি আমাদের জন্য একটি বড় শিক্ষা। আমরা মানুষ। আমরা নিজেদের সৃষ্টির সেরা জীব মনে করি। আমরা এই পৃথিবীতে রাজত্ব করার চেষ্টা করি। কিন্তু সত্যিই কি আমরা সব জানি? আমাদের জ্ঞান আসলে কতটুকু? আমরা কি সেই কুয়ার ব্যাঙের মতো শুধু আমাদের চারপাশের ছোট জগৎকেই সব ভাবি? যখনই বিশাল কোনো কিছুর কথা শুনি, তখন কি আমরা কুয়ার ব্যাঙের মতো অবিশ্বাস করি?

আমরা পৃথিবীর নরম আবরণের অর্থাৎ মাটির উপরে বাস করি। এই মাটি বা পৃথিবীর ভূত্বকের গভীরে আমরা কতটুকু যেতে পেরেছি? মানুষ চেষ্টা করেছে। বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আমরা সম্ভবত সর্বোচ্চ ১২ কিলোমিটার পর্যন্ত গভীরে যেতে পেরেছি। এর চেয়ে গভীরে যাওয়া মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়নি। আমরা পৃথিবীর উপরিভাগের অল্প একটু জানি। মাটির গভীরে কী আছে, তার বেশিরভাগই আমাদের অজানা।

এবার আসি আমাজন জঙ্গলের কথায়। এই জঙ্গল বিশাল। ঘন গাছপালায় ভরা। এই জঙ্গলে কত ধরনের বিচিত্র প্রাণী আছে, তা কি আমরা সব জানি? বিজ্ঞানীরা বলেন, আমাজন জঙ্গলে এত ধরনের প্রাণী ও উদ্ভিদ আছে যা মানুষের ধারণারও বাইরে। অনেক প্রজাতি হয়তো এখনো আবিষ্কৃতই হয়নি। প্রকৃতির এই অপার রহস্য আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাকেই দেখিয়ে দেয়।

এরপর আসি মহাসাগরের কথায়। পৃথিবী পৃষ্ঠের বেশিরভাগ অংশই মহাসাগর দিয়ে ঢাকা। এই বিশাল জলরাশি সম্পর্কে মানুষের ধারণা কতটুকু? জানলে অবাক হতে হয়, মানুষ এখনো মহাসাগরের মাত্র ০.৫ শতাংশ সম্পর্কে ধারণা অর্জন করতে পেরেছে। বাকি ৯৯.৫ শতাংশই আমাদের কাছে অজানা রয়ে গেছে। এই বিশাল জলরাশির গভীরে কত ধরনের বিচিত্র প্রাণী বাস করে, তা আমরা জানি না। মহাসাগরের গভীরে এমন অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে, যা মানুষ এখনো আবিষ্কার করতে পারেনি। এমনকি তথাকথিত বারমুডা ট্রায়াঙ্গল (গল্পে ‘বাবুয়া ট্রায়াঙ্গল’) এর মতো কিছু রহস্যময় স্থান সম্পর্কেও মানুষ স্পষ্ট ধারণা লাভ করতে পারেনি। মহাসাগরের গভীরতা, এর ভেতরের জগত—সবই আমাদের কাছে এক বিরাট অজানা অধ্যায়। কুয়ার ব্যাঙ যেমন মহাসাগরের বিশালতা বুঝতে পারেনি, তেমনই আমরা হয়তো প্রকৃতির বিশালতার সামান্যই বুঝতে পেরেছি।

শুধু প্রকৃতি নয়, আমরা মানুষ। আমরা নিজেদের খুব বুদ্ধিমান প্রাণী মনে করি। কিন্তু আমাদের নিজেদের ইতিহাসেই এমন কিছু জিনিস আছে যা আমরা ব্যাখ্যা করতে পারি না। যেমন মিশরের পিরামিড। এত বিশাল বিশাল পাথর ব্যবহার করে এই পিরামিডগুলো কীভাবে তৈরি হলো? কে বা কারা তৈরি করলো? বিজ্ঞানীরা এখনো এর সঠিক রহস্য ভেদ করতে পারেননি। আধুনিক প্রযুক্তির যুগেও এটি আমাদের কাছে একটি বড় প্রশ্ন। এটা কি প্রমাণ করে না যে আমাদের জ্ঞান এখনো কতটা সীমিত?

আমরা এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৌরজগতের পৃথিবী নামক ছোট গ্রহে বসবাস করি। এই মহাবিশ্ব কত বিশাল, তা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। এত বড় বড় বৈজ্ঞানিক আছেন। কিন্তু তারা এখনো পর্যন্ত সৌরজগতের প্রতিটি গ্রহে সশরীরে যেতে পারেননি। মানুষ মহাকাশে নিজেদের তৈরি মহাকাশ স্টেশন পাঠিয়েছে। সেই স্টেশন দিনে ১৬ বার সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দেখে। এটি চারটি বড় মাঠের সমান বিশাল। কিন্তু এত বড় স্টেশনটি কীভাবে মহাকাশে ভেসে রইলো? যে শক্তি একে ভাসিয়ে রেখেছে, সেই শক্তির উৎস বা কারণ আমাদের অনেকের কাছেই হয়তো তুচ্ছ মনে হতে পারে, কিন্তু এর পেছনের বিজ্ঞান জটিল এবং এর শক্তি বিশাল।

মানুষের তৈরি মহাকাশযান ভয়েজার ওয়ান এবং ভয়েজার টু আমাদের সৌরজগত পার হয়ে অনেক দূরে চলে গেছে। যখন তারা আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির বাইরে যাওয়ার আগে অনেক দূর থেকে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে সর্বশেষ ছবি তুলেছিল, সেই ছবিতে আমাদের পৃথিবীটা ছিল কলমের একটি বিন্দুর মতো। ভাবুন একবার, আমরা যে পৃথিবীতে বাস করি, যে পৃথিবী নিয়ে আমরা এত অহংকার করি, লড়াই করি—মহাকাশের বিশালতার তুলনায় সেটা একটা বিন্দুর চেয়েও ছোট! আসলে আমরা কত ছোট!

আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির বাইরে অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি আছে। আরও কত বিলিয়ন ট্রিলিয়ন গ্যালাক্সি এই মহাবিশ্বে ছড়িয়ে আছে, তার কোনো শেষ নেই। সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কেউ হয়তো এর পূর্ণ হিসাব জানেন না। এই মহাবিশ্বের বিশালতা আমাদের ধারণারও বাইরে। মাত্র কয়েক বছর আগে মানুষ ব্ল্যাক হোল সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা লাভ করতে শুরু করেছে। অথচ মহাবিশ্বে ব্ল্যাক হোল সম্ভবত অগণিত। এটিও প্রমাণ করে যে মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমরা কতটা কম জানি।

তাহলে বুঝুন, আমাদের পৃথিবীটা এই বিশাল মহাবিশ্বের তুলনায় কতটা নগণ্য! সাগর পাড়ের যে বিশাল বালুচর থাকে, সেই বালুচরের একটি ক্ষুদ্র বালুকণার চেয়েও হয়তো পৃথিবীটা ক্ষুদ্র। আর সেই ক্ষুদ্র পৃথিবীর বুকে বসবাস করা আমরা মানুষ আসলে কত ছোট! আমরা কত অসহায়!

অথচ এই ছোট এবং অসহায় অবস্থা সত্ত্বেও মানুষ নিজেদের মধ্যে শক্তির লড়াইয়ে ব্যস্ত। আমরা এই ক্ষুদ্র পৃথিবীটাকেই ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছি। চারিদিকে হিংসা, মারামারি, যুদ্ধ চলছে। কে কাকে ঠকাবে, কে সম্পদ বেশি অর্জন করবে—এই নিয়েই আমাদের প্রতিযোগিতা। আমরা ভুলে যাই যে এই ছোট পৃথিবী আমাদের সবার ঘর। এটিকে নষ্ট করলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কোথায় যাবে?

আসুন, আমরা আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করি। মহাবিশ্বের বিশালতার সামনে নিজেদের ক্ষুদ্রতা স্বীকার করি। নিজেদের মধ্যেকার সব হিংসা, মারামারি, যুদ্ধ বন্ধ করি। সম্পদ অর্জনের অন্ধ প্রতিযোগিতা থেকে বেরিয়ে আসি। আসুন আমরা শান্তিময় পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হই। এই ছোট্ট সুন্দর পৃথিবীটাকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদেরই। আমরাই পারি আমাদের পৃথিবী নামক এই গ্রহটাকে আগামী প্রজন্মের বসবাসের জন্য একটি নিরাপদ এবং সুন্দর স্থান হিসেবে উপহার দিতে। আমাদের ক্ষুদ্রতা মেনে নিয়েও আমরা ভালোবাসা আর শান্তি দিয়ে এই জগতকে সুন্দর করতে পারি। কুয়ার ব্যাঙের মতো সংকীর্ণ না থেকে মহাসাগরের বিশালতার মতো মন নিয়ে বাঁচতে শিখি।

লেখক : সহকারী শিক্ষক, কাইচতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বান্দরবান সদর।