
অজানার সরল বিশ্বাস আর দ্রুত লাভের আশায় মাছ চাষে অবাধে ব্যবহৃত হচ্ছে উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক। সাধারণ সর্দি-কাশির মতো, মাছের সামান্য অসুখেও খামারিরা কোনো বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়াই সরাসরি পুকুরের পানিতে ঢেলে দিচ্ছেন বিভিন্ন শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক। এর ফলে মাছ যেমন অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠছে, তেমনই এসব মাছ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে নীরবে বিষ ঢুকছে মানবদেহে। শুধু তাই নয়, এই অ্যান্টিবায়োটিক আশঙ্কাজনক হারে ছড়িয়ে পড়ছে দেশের নদ-নদী ও কৃষিজমিতে, যা জনস্বাস্থ্যের পাশাপাশি দেশের জলজ প্রাণী ও সার্বিক জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। চট্টগ্রামের মতো গুরুত্বপূর্ণ মৎস্য উৎপাদনকারী অঞ্চলের জন্যও এটি এক অশনি সংকেত।
দেশের অধিকাংশ মৎস্যচাষীই অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করেন বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। মাছের দ্রুত বৃদ্ধি, রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারের নামে মূলত অজ্ঞতা, অসচেতনতা এবং কিছু অসাধু ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি ও স্থানীয় ফিড ব্যবসায়ীদের প্রলোভনের ফাঁদে পা দিচ্ছেন তারা।
চাষের মাছে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ নিয়ে ২০২২ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনে এই ভয়াবহ চিত্র ফুটে ওঠে। বিশ্বের খ্যাতনামা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, মৎস্য গবেষকসহ ১৫ জনের একটি দল এই গবেষণায় অংশ নেন। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি), মালয়েশিয়া ও ঢাকার ওয়ার্ল্ড ফিশ এবং অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলসের মতো স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের গবেষকরাও ছিলেন। গবেষকরা দেশের ছয়টি প্রধান মৎস্য উৎপাদনকারী জেলা – ময়মনসিংহ, যশোর, কুমিল্লা, সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট থেকে ৬৭২টি মাছের খামারের নমুনা বিশ্লেষণ করেন।
গবেষণায় দেখা যায়, প্রায় ৭৭ শতাংশ মাছচাষীই তাদের পুকুর বা ঘেরে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করেছেন। তাদের ভাষ্যমতে, মাছের রোগ সারাতে এবং রোগ প্রতিরোধ করতে – এই দুই কারণেই তারা এটি প্রয়োগ করেন। তবে এর নেপথ্যে দ্রুত বৃদ্ধি ও অধিক মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যও প্রকট। অনভিজ্ঞ মাছচাষীদের মধ্যেই অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের প্রবণতা সর্বাধিক, যাদের মূলত ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরাই উৎসাহিত করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. নিয়ামুল নাসের এ বিষয়ে বলেন, “পোলট্রিতে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের দেখাদেখি মাছে এর প্রয়োগ শুরু হয়েছে, যা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। মুরগিকে দেওয়া অ্যান্টিবায়োটিক পরিবেশে সেভাবে ছড়ায় না, কারণ মুরগি তা খেয়ে ফেলে। কিন্তু মাছে প্রয়োগ করা অ্যান্টিবায়োটিক সরাসরি পানিতে মেশে এবং মাছের শরীরে অতিরিক্ত হিসেবে থেকে যায়, যা পরবর্তীতে মানবদেহে প্রবেশ করে।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন, “মাছ ও পানিতে অনেক উপকারী ব্যাকটেরিয়া থাকে। অপ্রয়োজনে ও অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগে এই ভালো ব্যাকটেরিয়াগুলো মারা যায়, আর ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াগুলো আরও বেশি প্রতিরোধী হয়ে ওঠে। এই মাছ খেলে মানবদেহেও অ্যান্টিবায়োটিক ঢুকে যায়, ফলে সাধারণ রোগের চিকিৎসায়ও এখন উচ্চমাত্রার দামি অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে হচ্ছে, কারণ কম মাত্রার ওষুধ আর কাজ করছে না।”
গবেষণায় পাঙাশ, তেলাপিয়া, গলদা ও বাগদা চিংড়ি, কার্প জাতীয় মাছ (রুই, কাতলা, মৃগেল, গ্রাস কার্প, সিলভার কার্প), পাবদা, টেংরা, শিং, মাগুর ও কই মাছের খামারে অক্সিটেট্রাসাইক্লিন, এনরোফ্লক্সাসিন, সিপ্রোফ্লক্সাসিন, অ্যামোক্সিসিলিনসহ বিভিন্ন শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারের প্রমাণ মিলেছে। পরিমিত মাত্রার বেশি এসব অ্যান্টিবায়োটিক মাছের জন্য যেমন ক্ষতিকর, তেমনই তা গ্রহণকারী মানুষের শরীরকেও করে তোলে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক এএসএম সাইফুল্লাহ বলেন, “পুকুর বা ঘেরের অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক মিশ্রিত পানি নানা উপায়ে দেশের নদ-নদী ও কৃষিজমিতে ছড়িয়ে পড়ে। মানবদেহে প্রবেশ করা অ্যান্টিবায়োটিকও প্রস্রাবের মাধ্যমে পরিবেশে মেশে। এতে কৃষি উৎপাদন, মুক্ত জলাশয়ের মাছ, সাপ, ব্যাঙসহ সার্বিক জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।”
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রেতা জানান, বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা তাদের কাছে অ্যান্টিবায়োটিক সরবরাহ করেন এবং চাষীদের কাছে তা বিক্রির জন্য উৎসাহিত করেন। কোম্পানির নির্দেশনামাফিক তারা চাষীদের প্রয়োগবিধিও বাতলে দেন।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মৎস্যচাষী সমিতির নেতারাও স্বীকার করেছেন, নতুন ও অনভিজ্ঞ চাষীরাই মূলত কোম্পানির প্রলোভনে পড়ে মাত্রাতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করছেন, যা নির্দিষ্ট সময় পর অপসারণ না করায় মাছ ও পরিবেশ উভয়েরই ক্ষতি করছে। মৎস্য কর্মকর্তারা বারবার অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে চাষীদের নিরুৎসাহিত করলেও, কিছু কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি ও অসাধু ব্যবসায়ীরা নিজেদের বিক্রির স্বার্থে চাষীদের ভুল পথে চালিত করছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মাছে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের আদৌ কোনো প্রয়োজন নেই যদি পুকুর, মাটি ও পানির গুণগত মান সঠিকভাবে বজায় রাখা যায়। খামারিদের অজ্ঞতা দূর করতে এবং তাদের সঠিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মাছ চাষে উৎসাহিত করতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ব্যাপক প্রশিক্ষণের আয়োজন করা জরুরি। পাশাপাশি, যে সকল কোম্পানি ও তাদের প্রতিনিধিরা মাছচাষীদের ভুল বুঝিয়ে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে প্ররোচিত করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। নতুবা, সুস্বাদু মাছের প্লেটটিই হয়ে উঠবে আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য এক নীরব ঘাতক।
