সিন্ডিকেট কারসাজিতে চট্টগ্রামে চামড়ার দরে ধস, পুঁজি হারালেন শত শত ব্যবসায়ী


ঈদের দিনে আড়তে ভালো দাম পাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে যারা কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করেছিলেন, তাদের সেই স্বপ্ন পথেই শেষ হয়েছে। কাঙ্ক্ষিত দাম না পেয়ে চট্টগ্রামের বিভিন্ন রাস্তায় কয়েকশ মৌসুমী ব্যবসায়ী তাদের সংগ্রহ করা চামড়া ফেলে গেছেন। কোথাও কোথাও মাটিতে পুঁতে ফেলার ঘটনাও ঘটেছে। রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা নগরীর বিভিন্ন সড়ক থেকে প্রায় ১০ টন ফেলে দেওয়া চামড়া অপসারণ করেন। এটি ছিল চট্টগ্রামে কোরবানির চামড়ার বাজারে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় দরপতনের এক হতাশাজনক প্রতিচ্ছবি।

ঈদের দিন দুপুর গড়াতেই চট্টগ্রামের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মৌসুমী ব্যবসায়ীরা চামড়া নিয়ে আড়তে আসতে শুরু করেন। কিন্তু আড়তদারদের নির্ধারণ করা দামে তাদের মাথায় হাত পড়ে। সরকার নির্ধারিত দাম তো দূরের কথা, কেনা দামও তুলতে না পেরে তারা প্রতিবাদ হিসেবে চামড়া রাস্তায় ফেলে দেন।

ক্ষতিগ্রস্ত মৌসুমী বিক্রেতারা অভিযোগ করেন, আড়তদার ও বড় চামড়া ব্যবসায়ীরা পরিকল্পিতভাবে সিন্ডিকেট করে চামড়ার দাম কমিয়ে দিয়েছেন। তাদের যোগসাজশের কারণেই দামের এই আকস্মিক ধস নেমেছে। এর ফলে পুঁজি হারিয়ে পথে বসেছেন শত শত ছোট ও মৌসুমী ব্যবসায়ী।

তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আড়তদাররা। বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মাহবুবুল আলম বলেন, “অনেকেই বেশি দাম চাওয়ায় ক্রেতা পাননি। আবার অনেকে চামড়া আনতে দেরি করেছেন, ততক্ষণে চামড়া পচে যাওয়ায় কেউ তা কেনেনি।” তিনি জানান, তারা শুরুতে ভালো মানের চামড়া ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় কিনেছেন, তবে পরে পচন ধরতে শুরু করা চামড়া ২০০ টাকাতেও কিনেছেন।

আশ্চর্যজনকভাবে, এই বাজার বিপর্যয় এমন এক সময়ে ঘটল যখন সরকার চামড়ার দাম গত বছরের চেয়ে বাড়িয়ে নির্ধারণ করে দিয়েছিল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ঢাকার বাইরের জন্য লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ৫৫-৬০ টাকা নির্ধারণ করেছিল, যা গত বছর ছিল ৫০-৫৫ টাকা। কিন্তু মাঠের চিত্র ছিল ঠিক তার উল্টো।

এই পরিস্থিতি শুধু চট্টগ্রামের একার নয়, বরং এটি দেশের পুরো চামড়া শিল্পের গভীর সংকটেরই প্রতিফলন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চামড়ার দাম না বাড়ার পেছনে মূল কারণ হলো সাভারের হেমায়েতপুরে অবস্থিত চামড়াশিল্প নগরের পরিবেশগত সংকট। এই শিল্পনগরের কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) পুরোপুরি কার্যকর না হওয়ায় এবং পরিবেশ দূষণ বন্ধ না হওয়ায় ইউরোপ-আমেরিকার নামীদামী ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশ থেকে সরাসরি চামড়া কেনা বন্ধ করে দিয়েছে।

ফলে বাংলাদেশি চামড়ার প্রধান ক্রেতা এখন চীন, যারা তুলনামূলকভাবে কম দাম দেয়। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান র‍্যাপিডের নির্বাহী পরিচালক ড. মো. আবু ইউসুফ বলেন, “হেমায়েতপুরের চামড়াশিল্প নগরকে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী পরিবেশবান্ধব করা গেলে বছরে ১০-১২ বিলিয়ন ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি সম্ভব। সেটি হলে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম এমনিতেই বেড়ে যেত।”

সুতরাং, চট্টগ্রামের রাস্তায় পড়ে থাকা ১০ টন চামড়া কেবল স্থানীয় আড়তদারদের কারসাজি বা মৌসুমী ব্যবসায়ীদের অজ্ঞতার ফল নয়, বরং এটি জাতীয় পর্যায়ের একটি পদ্ধতিগত ব্যর্থতারই বহিঃপ্রকাশ। যতক্ষণ পর্যন্ত চামড়া শিল্পের দূষণ সমস্যার সমাধান না হবে, ততক্ষণ চট্টগ্রামের মতো সারাদেশের হাজারো মৌসুমী ব্যবসায়ীর স্বপ্ন এভাবেই পথের ধুলায় মিশে যাবে।