
বাংলাদেশকে বলা হয় নদীমাতৃক দেশ। পদ্মা, মেঘনা, যমুনার মতো বিশাল নদীগুলো হিমালয় থেকে যাত্রা শুরু করে নানা দেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে অবশেষে সাগরে মিলিত হয়েছে। কিন্তু এই চেনা চিত্রের বাইরেও আমাদের একটি নিজস্ব নদী আছে, যার জন্ম ও শেষ এই বাংলাদেশেই। সেই নদীর নাম সাঙ্গু। বান্দরবান জেলার উঁচু পাহাড় থেকে জন্ম নিয়ে এই নদী থানচি, রুমা, রোয়াংছড়ি ও বান্দরবান সদর হয়ে এঁকেবেঁকে নেমে এসেছে সমতলে।
পাহাড়ের গভীরে এর জন্ম, যেখানে মেঘেরা পাহাড়ের চূড়ায় বিশ্রাম নেয়। সেখান থেকে পাথরের বুকে আছড়ে পড়ে, গর্জন করতে করতে খরস্রোতা সাঙ্গু নেমে আসে নিচের দিকে। তার চলার পথে শত শত ঝরনা এসে নিজেদের সঁপে দেয়। রুমা বা থানচির পাহাড়ি বাঁকে সে যেমন বুনো ও দুরন্ত, তেমনি সমতলে এসে সে শান্ত ও উদার, দুই কূলকে উর্বর পলিতে ভরিয়ে দিয়ে যায়।
সাঙ্গুর দুই পাড়ের জীবনযাত্রা বড়ই বিচিত্র। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে থাকা মানুষগুলো মূলত জুম চাষ এবং নদীতে মাছ শিকারের মাধ্যমে তাদের সংসার চালায়। তাদের সহজ-সরল জীবনধারা এই নদীর প্রবাহের মতোই ছন্দময়। এই নদীটিই পরে কর্ণফুলীর সঙ্গে মিশে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। তাই বলা যায়, সাঙ্গু আমাদের একান্তই নিজের নদী। এই নদীর বাঁকে বাঁকে লুকিয়ে আছে বহু ইতিহাস, রহস্য আর মানুষের মুখে মুখে ফেরা নানা লোককথা।
আজকের যে খরস্রোতা সাঙ্গুকে আমরা দেখি, তার গতিপথ সব সময় এমন ছিল না। মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে, এই নদীর বুকে জেগে ওঠা বিশাল ‘বড় সাঙ্গুর চর’ কীভাবে তৈরি হলো? এর উত্তর খুঁজতে আমাদের ফিরে যেতে হবে পাঁচ দশকেরও বেশি সময় আগে।
বৃদ্ধদের ভাষ্যমতে, ১৯৭০ সালের আগে সাঙ্গু নদীর মূল ধারাটি ছিল ভিন্ন। এটি বান্দরবান থেকে বাইদ্যাখালি হয়ে, যা আজ ‘ভরা সাঙ্গু’ নামে পরিচিত, সেই পথ ধরে আঁকাবাঁকাভাবে এগিয়ে গিয়ে কর্ণফুলী নদীতে মিশেছিল। তখন বাইদ্যাখালির বর্তমান গতিপথটি ছিল ছোট্ট একটি খালের মতো। কিন্তু ১৯৭০ সালের এক ভয়াবহ বন্যা প্রকৃতির এক উন্মত্ত খেয়ালে এই অঞ্চলের সবকিছু পাল্টে দেয়।
সেই প্রলয়ংকরী বন্যায় সাঙ্গু নদীর স্রোত এতটাই প্রবল ছিল যে, এটি তার পুরনো পথ ছেড়ে বাইদ্যাখালির ওই ছোট্ট খালটিকেই মূল পথ হিসেবে বেছে নেয়। প্রবল বেগে পানি প্রবাহিত হতে শুরু করে খোদার হাটের দিকে। অন্যদিকে, পুরনো যে মূল নদী, অর্থাৎ ‘ভরা সাঙ্গু’, সেখানে পাহাড় থেকে নেমে আসা বিশাল পলি জমে ধীরে ধীরে ভরাট হতে শুরু করে। কালের পরিক্রমায় সেই ভরা নদীই পরিণত হয় এক বিশাল চরে, যার নামকরণ হয় ‘বড় সাঙ্গুর চর’।
নদীর গতিপথের এই পরিবর্তন মানুষের ভাগ্যও বদলে দেয়। নদীর এই খামখেয়ালিপনা একদিকে যেমন পুরনো জনপদকে স্মৃতিতে পরিণত করেছিল, তেমনি অন্যদিকে তৈরি করেছিল নতুন সম্ভাবনার দুয়ার। পলি জমে তৈরি হওয়া এই চরের উর্বর জমিতে শুরু হয় ব্যাপক চাষাবাদ। এই চরের উর্বর মাটি যেন এক আশীর্বাদ হয়ে আসে। বিশেষ করে খাগরিয়ার আলু এবং দোহাজারীর বেগুন তাদের স্বাদ ও মানের জন্য দেশজুড়ে খ্যাতি লাভ করে। এছাড়া বারো মাসই নানা ধরনের সবজি ও ফসলে সবুজ হয়ে থাকে এই চর।
ইতিহাসের পাশাপাশি এই ভরা সাঙ্গুকে ঘিরে প্রচলিত আছে এক রহস্যময় লোককথা। শোনা যায়, এক রূপসী কন্যার কথা। পূর্ণিমার রাতে, কখনো বা গভীর সন্ধ্যায়, ওই রূপসী কন্যা নাকি দামি হীরা, মুক্তা আর সোনা-রুপার গহনায় সেজে ভরা সাঙ্গুর বুকে বিচরণ করতেন। তার রূপে মুগ্ধ হয়ে বা অলংকারের লোভে কোনো মানুষ তার পিছু নিলেই ঘটত বিপদ। কিছুদূর যাওয়ার পর রূপসী কন্যা পেছনে ফিরে এক ভেলকি দিতেন, আর তাতেই সেই লোভী মানুষের ‘খেল খতম’ হয়ে যেত। এই উপাখ্যান কি শুধুই একটি গল্প? নাকি নদীর বুকে লুকিয়ে থাকা প্রাকৃতিক সম্পদ আর মানুষের লোভের এক রূপক প্রতিচ্ছবি? তা হয়তো জানা যাবে না, কিন্তু এই গল্প আজও মানুষের মনে এক রহস্যময় শিহরণ জাগায়।
এই চরের পাশেই নাকি ব্রিটিশ আমলে একটি বিমানবন্দর ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেখান থেকে যুদ্ধবিমান ওঠানামা করত বলে জানা যায়। কালের সাক্ষী হয়ে সেই বিমানবন্দর আজ আর নেই, কিন্তু রয়ে গেছে নদীর স্মৃতি, মানুষের মুখের গল্প আর মাঝিমাল্লাদের গান।
একটা সময় ছিল যখন এই সাঙ্গু নদী দিয়েই নৌকা, সাম্পান আর বোটে করে তামাক, ধান, আখ, তিল ও বাদামের মতো নানা ফসল যেত চট্টগ্রামে। মাঝি-মাল্লারা গলা ছেড়ে ভাটিয়ালি আর মুর্শিদি গান গেয়ে ছুটে চলত। সেই গানগুলো ছিল তাদের জীবনের প্রতিচ্ছবি—কখনো বিরহের, কখনো আনন্দের, আবার কখনো সৃষ্টিকর্তার প্রতি আত্মসমর্পণের। নদীর কলকল ধ্বনির সাথে মিশে সেই সুরগুলো এক মায়াবী পরিবেশ তৈরি করত, যা আজকের যান্ত্রিক যুগে প্রায় হারিয়ে গেছে।
আজ নদীর গতিপথ বদলেছে, বদলেছে মানুষের জীবনযাত্রা, কিন্তু সাঙ্গুর সেই স্মৃতি আর রূপসী কন্যার উপাখ্যান এখনো এই অঞ্চলের বাতাসে ভেসে বেড়ায়। এই লোককথা এতটাই জীবন্ত যে, আমার মনেও কখনো কখনো দুষ্টুমিভরা ইচ্ছে জাগে—যদি সত্যিই দেখা হতো সেই রূপসী কন্যার সাথে, তবে হয়তো তার কাছে এই অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য ফেরানোর জন্য কয়েকটি মণি-মুক্তা চেয়েই নেওয়া যেত!
লেখক: সহকারী শিক্ষক, কাইচতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বান্দরবান সদর।
