আগে পৃথিবী, তারপর না হয় মহাবিশ্ব!


কথাসাহিত্যিক আমিনুল হকের একটি গল্প মনে পড়ে যায়—কুয়ার ব্যাঙ আর মহাসাগরের ব্যাঙের গল্প। কুয়ার ব্যাঙটি ভাবত, তার ওই ছোট কুয়াটিই বুঝি পুরো জগৎ। মহাসাগরের ব্যাঙের কাছে সমুদ্রের বিশালতার কথা শুনে তার বিশ্বাসই হচ্ছিল না। আমাদের মানুষের অবস্থাও কি অনেকটা সেই কুয়ার ব্যাঙের মতো? আমরা নিজেদের জ্ঞান ও অর্জন নিয়ে গর্ব করি, কিন্তু এই বিশাল মহাবিশ্বের তুলনায় আমাদের জ্ঞান কতটুকুই বা! আমরা হয়তো সামান্য কিছু শিখেছি, কিন্তু যা অজানা রয়ে গেছে, তার পরিধি অসীম।

এই সীমাবদ্ধতা নিয়েই আমাদের অহংকারের শেষ নেই। দিন দিন মানুষ যেন তার মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলছে। একে অপরকে নিচে নামানোর এক অসুস্থ খেলায় আমরা মেতে উঠেছি। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে আমরা সত্যকে সহজেই চিনতে পারতাম, কিন্তু তার বদলে সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠা করার এক অশুভ প্রতিযোগিতা চলছে বিশ্বজুড়ে।

এই অসহনশীলতারই ভয়াবহ প্রতিচ্ছবি আমরা দেখতে পাচ্ছি আজকের পৃথিবীতে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আগুন এখনো জ্বলছে। এর মধ্যেই শুরু হয়েছে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের অন্তহীন সংঘাত, যাতে জড়িয়ে পড়েছে হিজবুল্লাহ এবং হুতি বিদ্রোহীরা। এখন আবার ইরান ও ইসরায়েল সরাসরি এক ভয়াবহ যুদ্ধে লিপ্ত। এই দেশগুলো যেন এক বিশাল দাবার বোর্ডের গুটি, যার কলকাঠি নাড়ছে পর্দার আড়ালে থাকা একেকটি পরাশক্তি। তাদের ক্ষমতার খেলায় বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ।

অথচ এই মানুষই আবার প্রযুক্তি দিয়ে বিশ্বকে চমকে দিচ্ছে। মহাকাশ নিয়ে যিনি একের পর এক বিস্ময় উপহার দিচ্ছেন, সেই ইলন মাস্কের কথা ভাবা যাক। তার প্রতিষ্ঠান হাজার হাজার স্যাটেলাইট আর শত শত রকেট মহাকাশে পাঠাচ্ছে। সম্প্রতি উৎক্ষেপণ করা তার রকেটটি একটি ২৪ তলা ভবনের সমান উঁচু। সবচেয়ে বড় বিস্ময় হলো, এই বিশাল রকেটটি মহাকাশে তার কাজ শেষ করে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসে। ঠিক যেন ক্রিকেট খেলায় একজন ফিল্ডারের বল ধরে ফেলার মতো—যেখান থেকে রকেটটি উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল, সেখানেই কোনো এক অজানা প্রযুক্তি তাকে আবার লুফে নেয়।

মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। আমরা অসম্ভবকে সম্ভব করার নেশায় ছুটে চলেছি। আমরা চাঁদে পা রেখেছি, মঙ্গলে রোবট পাঠিয়েছি। আমাদের পাঠানো নভোযান ভয়েজার-১ ও ভয়েজার-২ আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি পার হয়ে অজানার পথে আজও ছুটে চলেছে। এই অর্জনগুলো নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু এই সবকিছুর আগে আমাদের নিজেদের ঘর, অর্থাৎ এই পৃথিবী নিয়ে কি আমরা ভেবেছি?

আমাদের এই পৃথিবী সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা কি আজও সব রহস্য উদঘাটন করতে পেরেছেন? পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগই তো পানি। সেই মহাসমুদ্রের গভীরে কী আছে, কোন বিচিত্র প্রাণীর বাস সেখানে, তা কি আমরা পুরোপুরি জানতে পেরেছি? মহাসাগরের সব পানি লবণাক্ত করতে ঠিক কতটুকু লবণের প্রয়োজন হয়েছিল, তার উত্তর সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কেউ জানে না।

যদি ইলন মাস্ক তার রকেটকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনতে পারেন, তবে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের মতো এক অমীমাংসিত রহস্য উন্মোচনের জন্য তিনি কেন একটি স্যাটেলাইট বা ড্রোন সেখানে পাঠান না? কেন আজও বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের ওপর দিয়ে যাওয়া বিমান বা জাহাজ হারিয়ে যায়, তার কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা আমরা পাইনি। হাজার হাজার বছর আগে, যখন কোনো আধুনিক প্রযুক্তি ছিল না, তখন মিশরীয়রা কীভাবে একের পর এক বিশাল পাথর সাজিয়ে পিরামিড তৈরি করেছিল, তা আজও এক বড় রহস্য।

পৃথিবীর ফুসফুস বলে পরিচিত আমাজন জঙ্গলের কথাই ধরা যাক। সেখানে কত হাজার প্রজাতির গাছপালা, পশুপাখি আর কীটপতঙ্গ রয়েছে, তার সবকিছু কি বিজ্ঞানীরা আজও আবিষ্কার করতে পেরেছেন? পারেননি। আমাদের জ্ঞান এতটাই ক্ষুদ্র যে, ভয়েজার নভোযান যখন আমাদের সৌরজগৎ পার হয়ে যাচ্ছিল, তখন পৃথিবীর যে ছবিটি সে তুলেছিল, তাতে আমাদের এই গ্রহটাকে একটি কলমের ডগার বিন্দুর মতো দেখা গিয়েছিল।

তাহলে আমাদের এত অহংকার কিসের? আমরা তো মানুষের দ্বারা একটি কাঁচা মরিচ বা এক ফোঁটা রক্তও তৈরি করতে পারি না। একটি ধান বা একটি মাছ তৈরি করাও আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা এক গ্লাস পানিও সৃষ্টি করতে পারি না। তাহলে কেন এই ক্ষমতার লড়াই? কেন এক দেশ আরেক দেশকে আক্রমণ করছে? কেন অসহায় মানুষের কান্না আর জীবন বাঁচানোর জন্য দিগ্বিদিক ছোটাছুটি?

আমাদের এই ক্ষুদ্র জ্ঞান আর সীমাবদ্ধতা নিয়ে মহাবিশ্ব জয়ের স্বপ্ন দেখার আগে, আসুন আমাদের নিজেদের ঘরটাকে গুছিয়ে নিই। যে গ্রহে আমাদের জন্ম, যে গ্রহ আমাদের আশ্রয় দিয়েছে, তাকে রক্ষা করাই হোক আমাদের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব। মহাকাশ গবেষণা চলুক, কিন্তু তার আগে বন্ধ হোক পৃথিবীর বুকে চলা এই ধ্বংসের খেলা।

আসুন, সৃষ্টিকর্তার দেওয়া এই সুন্দর পৃথিবীটাকে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য ও পরিবেশবান্ধব জায়গা হিসেবে গড়ে তুলি। যুদ্ধ নয়, আমরা শান্তি চাই। আগে পৃথিবী শান্ত হোক, তারপর না হয় এই বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নিয়ে ভাবা যাবে।

লেখক: সহকারী শিক্ষক, কাইচতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বান্দরবান সদর।