থিয়ানিস অ্যাপারেলস: এক আনিসের ‘চালে’ হেরে গেল রাষ্ট্র ও শ্রমিক!

বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা। চট্টগ্রামের ইপিজেড এলাকার মূল ফটকের সামনে বসে থাকা শত শত নারী-পুরুষ শ্রমিকের চোখে ক্ষোভ, ক্লান্তি আর অনিশ্চয়তা। তাদের দাবি মে ও জুন মাসের বকেয়া বেতন। শুনতে সামান্য মনে হলেও, থিয়ানিস অ্যাপারেলস লিমিটেডের প্রায় ৭০০ শ্রমিকের কাছে এটি এখন এক অধরা স্বপ্ন।

গত এক মাস ধরে তারা এই স্বপ্নের পেছনেই ছুটছেন। কিন্তু প্রতিবারই ঘরে ফিরছেন ‘আরেকটু সময় দিন’ বা ‘আগামী সপ্তাহে হয়ে যাবে’—এই জাতীয় ফাঁপা আশ্বাস নিয়ে। যে প্রতিশ্রুতি একসময় তাদের বেঁচে থাকার আশা জোগাত, তা-ই এখন রূপ নিয়েছে তীব্র হতাশা আর ক্ষোভে।

বর্তমান সংকট ও শ্রমিকদের আহাজারি

প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের ধারাবাহিকতায় সবশেষ গত ৭ জুলাই সকাল ১০টায় থিয়ানিসের শ্রমিকরা ইপিজেডের বেপজা (বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন অথোরিটি) অফিসের সামনে জড়ো হয়ে আন্দোলনে নামেন এবং সড়ক অবরোধ করেন। বেপজা কর্তৃপক্ষ ১০ জুলাইয়ের মধ্যে বকেয়া পরিশোধের বিষয়ে আলোচনার আশ্বাস দিলেও শ্রমিকরা তা প্রত্যাখ্যান করেন। তারা মিছিল নিয়ে ফ্রি পোর্ট মোড়ে গিয়ে এয়ারপোর্ট সড়ক অবরোধ করেন, যার ফলে শহরের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয় এবং সাধারণ যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

আন্দোলনরত শ্রমিকদের অভিযোগ, কারখানা কর্তৃপক্ষ গত ২৬ জুন এবং ২ জুলাই বেতন দেওয়ার কথা বলেও কথা রাখেনি। মে ও জুনের বেতন বকেয়া থাকায় বাড়িভাড়া দেওয়া থেকে শুরু করে নিত্যদিনের খাবার জোগাড় করতেই হিমশিম খাচ্ছেন তারা।

শুধু শ্রমিক নয়, ঋণের জালে রাষ্ট্রও

অনুসন্ধানে জানা গেছে, থিয়ানিস অ্যাপারেলসের মালিক আনিসুর রহমান খানের বিরুদ্ধে শুধু শ্রমিকদের বেতন বকেয়া রাখার অভিযোগই নয়, তার কাছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোরও পাওনা রয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। বেপজার পাওনা প্রায় ৩১ কোটি টাকা (২৬ লাখ মার্কিন ডলার) এবং কাস্টমসের পাওনা আরও ৫৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণের বোঝাও রয়েছে।

বেপজা আইন ২০১০-এর ৭(২)(ঘ) ধারা অনুযায়ী, কোনো প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হলে কর্তৃপক্ষ তার ইজারা বাতিল এবং কার্যক্রম স্থগিত করতে পারে। প্রশ্ন উঠেছে, এই বিশাল অঙ্কের বকেয়া যখন মাত্র কয়েক কোটি টাকা ছিল, তখন বেপজা বা অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সংস্থা কী ভূমিকা পালন করেছিল?

প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের দীর্ঘ ইতিহাস

থিয়ানিসের এই সংকট একদিনে তৈরি হয়নি। এর পেছনে রয়েছে মালিক আনিসুর রহমান খানের আইন, প্রশাসন, এমনকি আদালতকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার এক দীর্ঘ ও বিস্তৃত ইতিহাস।

সংশ্লিষ্ট সূত্র ও বেপজা কর্তৃপক্ষের ভাষ্যমতে, ২০০৮ সাল থেকেই প্রতিষ্ঠানটি সময়মতো ভাড়া ও অন্যান্য পাওনা পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছিল। বিভিন্ন সময়ে, যেমন ২০১০, ২০১২ এবং ২০১৭ সালেও, বেপজা কারখানাটির ইজারা বাতিল করে বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু প্রতিবারই মালিক আনিসুর রহমান নানা প্রতিশ্রুতি, ব্যক্তিগত যোগাযোগ, আদালতের স্থগিতাদেশ কিংবা রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে সেই সিদ্ধান্ত আটকে দিয়েছেন।

ইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক আব্দুস সোবহান জানান, “আমরা এর আগেও ৬ বার তার লাইসেন্স বাতিলের উদ্যোগ নিয়েছি। কিন্তু প্রতিবারই তিনি শ্রমিকদের বেতন-বোনাসের বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এসেছেন। কর্তৃপক্ষও চেয়েছে কারখানাটি চালু থাকুক।”

তিনি আরও জানান, ২০২৩ সালে কোরবানির ঈদের পর কারখানার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিল। তখনও নতুন প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি তা পুনরায় চালু করান। এমনকি ২০২৪ সালের এপ্রিলে যখন চূড়ান্তভাবে ইজারা বাতিল করা হয়, তখন ঈদের আগে শ্রমিকদের বেতন-বোনাসের কথা বলে তিনি আবারও সময় নেন, বেপজাও মানবিক কারণে সেই স্থগিতাদেশ সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করে।

আদালতের সঙ্গেও ‘চালবাজি’

পরবর্তীতে বকেয়া পরিশোধ না করে থিয়ানিস কর্তৃপক্ষ হাইকোর্টে একটি পিটিশন দায়ের করে। আদালতের আদেশ অনুযায়ী, প্রতি মাসে ৫৫ হাজার ডলার করে বকেয়া পরিশোধের শর্তে শুনানি স্থগিত হয়। কিন্তু ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি—এই তিন মাস অর্থ পরিশোধের পর তিনি আবারও খেলাপি হন। মার্চ মাসের টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে তিনি আদালত থেকে সময় বাড়িয়ে নেন, কিন্তু সেই বর্ধিত সময়েও টাকা দিতে পারেননি। আদালত তখন পরিষ্কার জানিয়ে দেন, সময়মতো টাকা না দিলে পূর্বের আদেশ বাতিল হয়ে যাবে। এরপরই ২০২৪ সালের ৪ জুন বেপজা চূড়ান্তভাবে প্রতিষ্ঠানটির আমদানি-রপ্তানি অনুমোদন স্থগিত করে ইজারা বাতিলের সিদ্ধান্ত কার্যকর করে।

অর্থ গেল কোথায়?

থিয়ানিসের মালিক আনিসুর রহমান খান বিভিন্ন গণমাধ্যমে দাবি করেছেন, বেপজা রপ্তানির অনুমতি স্থগিত করায় তিনি বেতন পরিশোধ করতে পারছেন না। তার একটি বড় চালান প্রস্তুত রয়েছে, যা পাঠাতে পারলেই সব বকেয়া পরিশোধ করতে পারবেন।

কিন্তু সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন, যখন বেপজা, কাস্টমস ও শ্রমিকদের কাছে তার কোটি কোটি টাকা বকেয়া, তখন তিনি কীভাবে নতুন কাজের অর্ডার নিয়েছেন এবং সেই অর্থ কোথায় যাবে, তার নিশ্চয়তা কী?

শুধু থিয়ানিসই নয়, নগরীর দুই নম্বর গেটে আনিসুর রহমানের আরেকটি পোশাক কারখানা রহিমা গার্মেন্টসেও একই রকম শ্রমিক অসন্তোষ রয়েছে। সেখানেও তিন মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে বলে শ্রমিকরা জানিয়েছেন।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে থিয়ানিস অ্যাপারেলসের মালিক আনিসুর রহমান খানকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

শেষ খেসারত দিচ্ছে রাষ্ট্র

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক আব্দুস সোবহান জানিয়েছেন, আপাতত সরকারি একটি তহবিল থেকে ধার করে শ্রমিকদের মে মাসের বেতনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কারখানাটি ইতোমধ্যে নিলামে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

তিনি বলেন, “আমরা কারখানার সম্পদের তালিকা করছি। তালিকা শেষে নির্বাহী দফতরের অনুমোদন নিয়ে এটি নিলামে বিক্রি করে প্রথমে শ্রমিকদের বকেয়া পরিশোধ করা হবে। এরপর সরকারের ধার করা টাকা সমন্বয় করে বেপজা ও কাস্টমসের পাওনা মেটানো হবে।”

বিষয়টি পরিষ্কার যে, একজন বেসরকারি শিল্পপতির খেলাপি ব্যবসার দায়ভার এখন রাষ্ট্রকেই নিতে হচ্ছে। শ্রমিকের বকেয়া বেতন থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতে মোতায়েন করা নিরাপত্তা বাহিনীর খরচ—সবই মেটাতে হচ্ছে জনগণের করের টাকায়। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে যিনি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ফাঁকি দিয়ে নিজেকে ‘সুযোগের বরপুত্র’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করলেন, তাকে এই পর্যায়ে নিয়ে আসার পেছনে জড়িতদের দায় কে নেবে, সেই প্রশ্নটিই এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।