বন্ধু আজাদ, জন্মদিনে আজ বড্ড বেশি মনে পড়ছে তোকে


আজ ১৫ জুলাই, তোর জন্মদিন বন্ধু। প্রতি বছর এই দিনটি এলে ক্যালেন্ডারের পাতাটা এক অদ্ভুত শূন্যতা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আনন্দের বদলে বুক চিরে বেরিয়ে আসে এক গভীর, চাপা দীর্ঘশ্বাস। কামাল পারভেজ ভাই যেমনটা লিখেছেন, তুই জন্মেছিলি এক বর্ষার দিনে। আসলেই তাই, তোর চরিত্রটা ছিল ঠিক বর্ষার মতোই—কখনো ঝুম বৃষ্টিতে সব ভিজিয়ে দেওয়া প্রাণশক্তি, কখনো বা মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা স্নিগ্ধতা, আবার কখনো অভিমানী মেঘের মতো গম্ভীর। আজ তুই আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তোর অগণিত স্মৃতি বর্ষার বারিধারার মতোই অবিরাম ঝরে চলেছে আমার হৃদয়ের উঠোনজুড়ে। আজ এই বর্ষণমুখর দিনে তোর স্মৃতিগুলোও যেন আরও বেশি জীবন্ত, আরও বেশি মর্মস্পর্শী।

তোর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের গল্পটা শুরু হয়েছিল সেই ১৯৯০ সালে, স্কুলজীবনের সেই সোনালি দিনগুলোতে। আমাদের বেঞ্চগুলো ছিল পাশাপাশি, স্বপ্নগুলোও ছিল মিলেমিশে একাকার। টিফিনের ফাঁকে বাদাম ভাগাভাগি থেকে শুরু করে ছুটির পর একসঙ্গে বাসায় ফেরা—আমাদের প্রতিটি মুহূর্ত ছিল নিখাদ বন্ধুত্বে মোড়া। আমাদের মধ্যে ছিল এক আশ্চর্য মনের মিল; একজনের চিন্তা যেন অন্যজন অনায়াসেই পড়ে ফেলতে পারত। কত ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, কত অট্টহাসি, কত খুনসুটি! আবার জীবনের কঠিন সময়ে, বিপদে-আপদে একে অপরের ঢাল হয়ে দাঁড়ানোর যে অলিখিত প্রতিজ্ঞা আমাদের ছিল, তা আমরা আগলে রেখেছিলাম জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। তোর প্রজ্ঞা, সাহস আর দূরদর্শী নেতৃত্বে ‘একুশে পত্রিকা’ আজ কেবল একটি সংবাদমাধ্যম নয়, এটি দেশজুড়ে আপসহীন ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার এক বিশ্বস্ত বাতিঘর। তোর এই অকাল প্রয়াণ যে কী বিশাল এক অপূরণীয় শূন্যতা তৈরি করেছে, তার গভীরতা কেবল আমিই অনুভব করতে পারি। তুই বেঁচে থাকলে আমরা, এই সমাজ, এই দেশ আরও কত কী যে পেত, তা ভেবে মনটা হাহাকার করে ওঠে।

তোর জীবন ছিল এক বহুবর্ণিল ক্যানভাস, কর্মমুখর আর অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ। ২৭ বছরের দীর্ঘ সাংবাদিকতার পথচলায় তুই শুধু নিজেকেই এক অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করিসনি, বরং অসংখ্য তরুণের হাতে তুলে দিয়েছিস সত্য প্রকাশের দুঃসাহসী কলম। শিখিয়েছিস, কীভাবে ভয়কে জয় করে সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে হয়। কিন্তু তোর পরিধি তো শুধু সাংবাদিকতার গণ্ডিতে বাঁধা ছিল না। তুই নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছিস মানুষের সেবায়। কখনো প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ কমিটিতে বসে শহরবাসীর জন্য কাজ করেছিস, কখনো বা ছুটে গিয়েছিস প্রত্যন্ত গ্রামে, চিকিৎসা সেবা ক্যাম্পের আয়োজন করেছিস অসহায় মানুষের জন্য। দেশ ও মানুষের প্রতি তোর এই নিখাদ, শর্তহীন ভালোবাসা আমাদের জন্য এক অনুসরণীয় আদর্শ হয়ে থাকবে। দলমত, ধর্ম, বয়স—কোনো কিছুই তোর কাছে বাধা ছিল না। সবাইকে আপন করে নেওয়ার এক আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল তোর, যা আজও আমাদের মুগ্ধ করে।

আজও চোখের সামনে ভাসে বিআরবি হাসপাতালের সেই বেদনাবিধুর দিনের কথা। তোর কেবিনে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তুই আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলি। যন্ত্রণাকাতর, ক্লান্ত চোখ দুটোয় ছিল কত না বলা কথা! তারপর সব বাঁধ ভেঙে শিশুর মতো হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলেছিলি, ‘নজরুল, তুই এসেছিস?’ সেই মুহূর্তে আমার চারপাশটা যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমার দুচোখ বেয়েও ঝরছিল অশ্রুর প্লাবন। বাবার মৃত্যুতেও সম্ভবত এতটা অসহায় লাগেনি, যতটা তোকে ওই অবস্থায় দেখে লেগেছিল। তোর সেই কান্না ছিল জমে থাকা কষ্ট, অভিমান আর আমার প্রতি তোর গভীর আস্থার বহিঃপ্রকাশ।

দুর্বল, কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে তুই আমার কাঁধে তোর জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান দুটি আমানতের ভার তুলে দিয়েছিলি—তোর নয়নের মণি, একমাত্র পুত্র অর্ঘ্য আর তোর রক্ত-ঘামে গড়া স্বপ্নের ‘একুশে পত্রিকা’। বলেছিলি, ‘বন্ধু, আমার অর্ঘ্যকে তুই দেখিস। ওকে মানুষের মতো মানুষ করিস।’ অর্ঘ্যকে নিয়ে তোর কত স্বপ্ন ছিল! তাকে সুশিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তোকে শেষ দিনগুলোতেও তাড়া করে ফিরেছে। আর ‘একুশে পত্রিকা’কে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তোর সেই আকুতি! সে তো শুধু একটি অনুরোধ ছিল না, ছিল এক কলমযোদ্ধার তার আজন্ম লালিত আদর্শকে টিকিয়ে রাখার আকুল আর্তি। বন্ধু, আমি তোকে কথা দিয়েছিলাম। হাজারো মানুষের ভিড়ে, তোর নিথর দেহের পাশে দাঁড়িয়ে আমি মনে মনে আবারও প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। আজও সেই কথায়, সেই প্রতিজ্ঞায় আমি অটল। যতদিন এই দেহে প্রাণ আছে, শত কষ্ট হলেও তোর এই দুটি আমানত আমি নিজের জীবনের চেয়েও বেশি যত্ন আর ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখার চেষ্টা করব।

কামাল পারভেজ ভাই লিখেছেন তোদের পিঠাপিঠি জন্মদিনের কথা, গানের আসরের কথা, কফি হাউসের সেই আড্ডার কথা। তোর সুকণ্ঠের কথাও সে উল্লেখ করেছে। সত্যিই তো, তোর কণ্ঠে ছিল এক অদ্ভুত মায়া। আমারও মনে পড়ে, কত নির্ঘুম রাতে তুই আর আমি কাটিয়েছি ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনে, কতবার তোর কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত শুনে মুগ্ধ হয়েছি। আজ এই জন্মদিনে সেই সব স্মৃতি বড় বেশি করে মনে পড়ছে। মনে হচ্ছে, এই তো তুই আছিস, আমার পাশেই বসে আছিস। তোর ভরাট কণ্ঠে হয়তো গেয়ে উঠবি, “কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে”।

বন্ধু, তুই আমাদের ছেড়ে কোথাও যাসনি। তুই সশরীরে অনুপস্থিত, কিন্তু তোর অস্তিত্ব আমাদের সত্তার সঙ্গে মিশে আছে। তুই বেঁচে আছিস তোর কর্মে, তোর আদর্শে, একুশে পত্রিকার প্রতিটি অক্ষরে। তোর সততা আর সাহসিকতা থেকে প্রেরণা নিয়ে জন্ম নেবে আরও হাজারো কলমযোদ্ধা। আমি বিশ্বাস করি, এই ঘুণে ধরা সমাজে একদিন তারা সত্যের মশাল জ্বালবে, দ্যুতি ছড়াবে। আর তাদের অগ্রভাগে হয়তো একদিন তোর স্বপ্নপূরণ করে নেতৃত্ব দেবে আমাদেরই প্রিয় অর্ঘ্য। সেদিন তুই নিশ্চয়ই দেখবি, তোর অর্ঘ্য তোর মতোই নির্ভীক, তোর মতোই আদর্শবান হয়েছে।

শুভ জন্মদিন, আজাদ। যেখানেই থাকিস, অনন্তলোকে, ভালো থাকিস বন্ধু। তুই আমাদের প্রেরণার বাতিঘর হয়ে বেঁচে থাকবি অনন্তকাল। তোর দেখানো পথেই আমরা হেঁটে চলব, আলো জ্বেলে যাবো আঁধার তাড়াতে।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।