
একদিকে কারখানার অবকাঠামো প্রস্তুত, আমদানিকৃত অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপনের কাজও শেষ। অন্যদিকে উদ্যোক্তারা ব্যাংকের ডিমান্ড নোটের কোটি কোটি টাকা পরিশোধ করে বসে আছেন। শুধু একটি গ্যাস-সংযোগের অভাবে উৎপাদনে যেতে পারছে না চট্টগ্রামের প্রায় ১৩০টি নতুন শিল্প-কারখানা। দেশের অর্থনীতির হৃদপিণ্ড বলে পরিচিত চট্টগ্রামে শিল্পায়নের চাকা এখন গ্যাস-সংকটের চোরাবালিতে আটকে গেছে, যেখানে বিনিয়োগকারীদের স্বপ্ন পরিণত হচ্ছে হতাশায়।
সংযোগের অপেক্ষায় শত কোটি টাকার বিনিয়োগ
চট্টগ্রামে শিল্পায়নের জন্য বিনিয়োগকারীদের কাছে পছন্দের তালিকায় শীর্ষে থাকলেও গ্যাস-সংযোগ না মেলায় সেই চিত্র এখন বদলে যাচ্ছে। কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (কেজিডিসিএল) কাছে নতুন সংযোগের জন্য প্রায় ১৩০টি আবেদন জমা পড়ে আছে।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে শিল্প খাতে নতুন কোনো সংযোগ দেওয়া হচ্ছে না। সংযোগের জন্য চলছে নানা টালবাহানা। ফলে হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ করেও বহু শিল্পোদ্যোক্তা এখন দিশেহারা। এই অচলাবস্থার কারণে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী মহলে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
ফাইলে বন্দি গ্যাস, মন্ত্রণালয়ে সিদ্ধান্তহীনতা
আশ্চর্যের বিষয় হলো, সংকটটি কেবল গ্যাসের অপ্রতুলতার কারণে নয়, বরং প্রশাসনিক জটিলতা ও সিদ্ধান্তহীনতার কারণেও তীব্র হয়েছে। কেজিডিসিএলের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, চট্টগ্রামে শতাধিক শিল্পকারখানা ব্যবসায়িক লোকসান বা ব্যাংক ঋণ জটিলতার কারণে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। এর পাশাপাশি সিইউএফএল সার কারখানা ও কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রেরও উৎপাদন বন্ধ। এসব বন্ধ থাকা কারখানা থেকে সাশ্রয় হওয়া গ্যাস সহজেই নতুন শিল্পে সংযোগ দেওয়া সম্ভব।
কিন্তু গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর জ্বালানি মন্ত্রণালয় ও পেট্রোবাংলায় কর্মকর্তা পর্যায়ে যে পরিবর্তন এসেছে, তাতে নতুন কর্মকর্তারা চলমান সংকট নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারছেন না। ফলে সাশ্রয়কৃত গ্যাস থাকা সত্ত্বেও নতুন সংযোগের ফাইলগুলো মন্ত্রণালয়েই আটকা পড়ে আছে।
চাহিদা ও জোগানের বিশাল ফারাক
বর্তমানে চট্টগ্রামে গ্যাসের দৈনিক চাহিদা প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট । কিন্তু এলএনজিনির্ভর এই অঞ্চলে কখনোই ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয় না। সংকটের কারণে বর্তমানে সরবরাহ নেমে এসেছে দৈনিক ২৬০ মিলিয়ন ঘনফুটে। এই সামান্য গ্যাস দিয়ে চালু থাকা শিল্প-কারখানাগুলোতেই উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, নতুন সংযোগ দেওয়া তাই পুরোপুরি বন্ধ।
থমকে গেছে অর্থনীতির চাকা
গ্যাস-সংকটের প্রভাব পড়েছে পুরো চট্টগ্রামের অর্থনীতিতে। একদিকে যেমন নতুন বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হচ্ছে, তেমনি বিদ্যমান শিল্পগুলোও ধুঁকছে। অর্থনৈতিক মন্দা ও উন্নয়ন প্রকল্পের ধীরগতির কারণে নির্মাণসামগ্রী উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে উৎপাদন কমেছে। কেজিডিসিএলের তথ্যমতে, প্রায় ১৩৫টি শিল্প-কারখানায় গ্যাসের ব্যবহার ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে।
বেসরকারি শিল্প গ্রুপ বিএসআরএমের জেনারেল ম্যানেজার তপন সেনগুপ্ত বলেন, ‘উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ কম হওয়ায় নির্মাণসামগ্রী উৎপাদন স্বাভাবিকের চেয়ে কম হচ্ছে। এর ওপর বর্ষা মৌসুমও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।’
এই অচলাবস্থায় শুধু শিল্প মালিকরাই নন, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গ্যাস বিতরণকারী সংস্থা কেজিডিসিএলও। কোম্পানির পরিচালনা খরচ বাড়লেও গ্যাস বিক্রি না বাড়ায় তাদের আয় কমে গেছে এবং রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমার পরিমাণও হ্রাস পেয়েছে। সব মিলিয়ে, প্রশাসনিক সিদ্ধান্তহীনতার কারণে চট্টগ্রামের শিল্পায়নের বিপুল সম্ভাবনা এখন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে দাঁড়িয়ে।
