- গোপালগঞ্জে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষের সময় সাঁজোয়া যানে সেনাসদস্যদের টহল। গোপালগঞ্জ, ১৬ জুলাই, ২০২৫। ছবি: এএফপি
গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পদযাত্রা কেন্দ্র করে নিষিদ্ধঘোষিত আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষে অন্তত চারজন নিহত এবং অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন। বুধবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত এই সহিংসতায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, সরকারি কর্মকর্তা ও এনসিপি নেতারা হামলার শিকার হন।
দিনভর এই সহিংসতা একটি অবাধ নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করা নিয়ে যেমন উদ্বেগ তৈরি করেছে, তেমনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরাপত্তা প্রস্তুতি ও ভূমিকা নিয়েও তুলেছে গুরুতর প্রশ্ন। আগাম তথ্য ও স্পষ্ট পূর্বাভাস থাকার পরও কেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা গেল না, তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
সকাল থেকেই দফায় দফায় হামলা
এনসিপির ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচি ঘিরে উত্তেজনার শুরু হয় বুধবার সকালেই। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে সদর উপজেলার খাটিয়াগড় চরপাড়ায় পুলিশের ওপর হামলা চালানো হয় এবং তাদের গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এই হামলায় একজন পুলিশ পরিদর্শকসহ তিন সদস্য আহত হন। এরপর ঘটনাস্থলে যাওয়া সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এম রাকিবুল হাসানের গাড়িতেও হামলা হয়।
বেলা পৌনে দুইটার দিকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে দুই-তিনশ নেতা-কর্মী শহরের পৌর পার্কে এনসিপির সমাবেশস্থলে হামলা চালিয়ে মঞ্চ ভাঙচুর ও ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে। এ সময় পুলিশ সদস্যরা সরে গেলে হামলাকারীরা কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়।
পরে এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা সমাবেশস্থলে পৌঁছে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য শেষ করার পরপরই তাদের ওপর আবারও হামলা শুরু হয়। হামলাকারীরা এনসিপি নেতা-কর্মী ও পুলিশের গাড়ি ঘিরে ফেলে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে এবং জেলা কারাগার চত্বর ও জেলা প্রশাসকের বাসভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে।
পূর্বাভাস ছিল, প্রস্তুতিতে ঘাটতি?
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, গোপালগঞ্জে এনসিপির কর্মসূচি ঘিরে যে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, তার ধারণা আগে থেকেই ছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উসকানি এবং আগের দিন থেকেই আশপাশের জেলা থেকে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের গোপালগঞ্জে জড়ো হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছিল।
এতগুলো স্পষ্ট ইঙ্গিত এবং সকালে পুলিশের ওপর সরাসরি হামলার পরও সমাবেশস্থল ও শহরজুড়ে কেন পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, সে প্রশ্ন তুলেছে এনসিপি। দলটির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী অভিযোগ করেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের সবকিছু ঠিক আছে বলে আশ্বাস দিলেও হামলার সময় তারা ‘নিষ্ক্রিয়’ ভূমিকা পালন করেছে।
এই ঘটনায় সরকারের কাছে আগাম গোয়েন্দা তথ্য ছিল কি না এবং থাকলেও কেন তা কাজে লাগানো হয়নি, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মতো দলগুলোও এ ঘটনার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতাকে দায়ী করেছে।
সেনা পাহারায় গোপালগঞ্জ ত্যাগ ও দেশজুড়ে প্রতিক্রিয়া
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয়ে একপর্যায়ে প্রশাসন গোপালগঞ্জে ১৪৪ ধারা এবং পরে কারফিউ জারি করে। ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। বিকেল পাঁচটার দিকে এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতা আখতার হোসেন, হাসনাত আবদুল্লাহ ও সারজিস আলমকে সেনাবাহিনীর একটি সাঁজোয়া যানে (এপিসি) করে পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে বের করে আনা হয়। পরে তারা সেনা পাহারায় খুলনা সার্কিট হাউসে পৌঁছান।
গোপালগঞ্জে হামলার প্রতিবাদে এনসিপি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরা তাৎক্ষণিকভাবে পদ্মা সেতু এলাকা, শাহবাগসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থান এবং ঢাকার বাইরে অন্তত ২০টি জায়গায় সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ করে।
রাতে খুলনায় এক সংবাদ সম্মেলনে এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এই হামলাকে ‘গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারীদের হত্যার উদ্দেশ্যে জঙ্গি কায়দার হামলা’ বলে অভিহিত করেন এবং এর প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণা দেন।
অন্তর্বর্তী সরকার এক বিবৃতিতে এই হামলার নিন্দা জানিয়ে বলেছে, অপরাধীদের শনাক্ত করে পূর্ণ জবাবদিহির আওতায় আনা হবে।

