চট্টগ্রাম বন্দরে মাশুল বৃদ্ধির ‘শক’, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির আশঙ্কা


ডলারের ঊর্ধ্বগতি আর চাহিদা সংকটে ধুঁকতে থাকা অর্থনীতিতে যেন ‘বজ্রাঘাত’ হয়ে আসছে চট্টগ্রাম বন্দরের মাশুল বৃদ্ধির ঘোষণা। প্রায় চার দশক পর, অর্থাৎ ১৯৮৬ সালের পর এই প্রথম দেশের প্রধান এই সমুদ্রবন্দর তাদের সব ধরনের সেবার মাশুল বাড়াতে চলেছে, যার গড় বৃদ্ধির হার প্রায় ৪০ শতাংশ। বন্দরের আধুনিকায়ন ও সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য এই পদক্ষেপকে ‘অপরিহার্য’ বলছে কর্তৃপক্ষ।

কিন্তু অন্যদিকে, ব্যবসায়ী ও শিল্প মালিকরা এই বিপুল বৃদ্ধিকে ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে দেখছেন, যা দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য এবং সর্বোপরি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার খরচের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেয়ে প্রস্তাবটি এখন আইন মন্ত্রণালয়ে চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায়। গেজেট আকারে প্রকাশিত হলেই কার্যকর হবে নতুন এই ট্যারিফ কাঠামো, যা নিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং ব্যবহারকারীদের মধ্যে চলছে এক তীব্র টানাপোড়েন।

কেন এই মাশুল বৃদ্ধি?

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের মতে, ১৯৮৬ সালে নির্ধারিত ট্যারিফ কাঠামোটি এখন যেন ‘জাদুঘরের নিদর্শন’। গত ৩৮ বছরে বন্দরের পরিচালন ব্যয়, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির রক্ষণাবেক্ষণ, নিরাপত্তা এবং কয়েক হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা বেড়েছে বহুগুণে।

চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক জানান, “ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বন্দরের নিজস্ব কেনাকাটার খরচও আকাশচুম্বী হয়েছে। এই মাশুল বৃদ্ধি থেকে প্রাপ্ত অর্থ বন্দরের উন্নয়নেই ব্যয় করা হবে। নতুন নতুন গ্যান্টিক্রেন সংযোজন, ইয়ার্ড সম্প্রসারণ এবং অটোমেশন করা হবে, যার চূড়ান্ত সুবিধা বন্দর ব্যবহারকারীরাই পাবেন।”

একই সুরে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “চট্টগ্রাম বন্দরের মতো কম মূল্যে বিশ্বের আর কোথাও শিপিং সেবা পাওয়া যায় না। এটি কোনো একতরফা সিদ্ধান্ত নয়। সব অংশীজনের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমেই একটি যুগোপযোগী ও বাস্তবসম্মত ট্যারিফ কাঠামো গঠন করা হয়েছে।”

মূল্যস্ফীতির নতুন ঢেউয়ের আশঙ্কা

বন্দর কর্তৃপক্ষের এই যুক্তি মানতে নারাজ ব্যবসায়ী ও শিপিং এজেন্টরা। তাদের মতে, ধাপে ধাপে না বাড়িয়ে একবারে প্রায় ৪০ শতাংশ মাশুল বৃদ্ধি অযৌক্তিক এবং আত্মঘাতী।

প্রিমিয়ার সিমেন্ট পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক তার উদ্বেগের কথা জানিয়ে বলেন, “ডলারের দাম ৭৬ টাকা থেকে বেড়ে ১২০ টাকা ছাড়িয়েছে। এতে আমাদের আমদানি ব্যয় এবং উৎপাদন খরচ দুটোই বেড়েছে। বাজারে চাহিদাও কম। এই চরম দুঃসময়ে বন্দরের চার্জ বাড়লে আমাদের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়বে। এর প্রভাব শেষ পর্যন্ত সিমেন্টের দামের ওপর পড়বে, যা সরাসরি নির্মাণ খাতে আঘাত হানবে।”

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম সুজন বলেন, “বন্দরের সেবার বিল আমাদের ডলারে পরিশোধ করতে হয়। ডলারের দাম বাড়ায় আমাদের খরচ তো এমনিতেই প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এর ওপর নতুন করে ট্যারিফ বাড়ানো হলে আমদানি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি আমাদের রপ্তানি খাতও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করার সক্ষমতা হারাবে।”

বাড়ছে কী কী, বাড়ছে কত?

নতুন ট্যারিফ কাঠামোতে বিভিন্ন সেবার মূল্য উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। কিছু উদাহরণ নিচে দেওয়া হলো:

* পণ্যের স্টাফিং (কন্টেইনারে ভরা): প্রতি কন্টেইনারে ২.৭৩ ডলার থেকে বেড়ে হবে ৬.৪১ ডলার।

* লিফট অফ-লিফট অন: প্রতি কন্টেইনারে ৫.৪৬ ডলার থেকে বেড়ে হবে*৮.১২ ডলার।

* গ্যান্টিক্রেন চার্জ (২০ ফুট কন্টেইনার): নতুন করে যুক্ত হচ্ছে ২০.৮০ ডলার।

* লোডিং/ডিসচার্জিং (২০ ফুট কন্টেইনার): প্রতি কন্টেইনারে প্রায় ৬৮ ডলার।

* স্টোর রেন্ট (গোডাউন ভাড়া): ৪ দিন ফ্রি টাইমের পর, ২৮ দিন পর্যন্ত ২০ ফুট কন্টেইনারের জন্য দৈনিক ভাড়া হবে ৬.৯০ ডলার।

২০১৩ সালে একবার মাশুল বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হলেও ব্যবসায়ীদের আপত্তিতে তা স্থগিত হয়ে যায়। এবার ২০১৯ সাল থেকে একটি স্প্যানিশ পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় নতুন এই কাঠামো তৈরি করা হয়েছে, যা এখন কার্যকরের দ্বারপ্রান্তে। একদিকে বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর অপরিহার্যতা, অন্যদিকে অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে টিকে থাকার লড়াই—এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য খুঁজে বের করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

তবে এই মাশুল বৃদ্ধির চূড়ান্ত প্রভাব যে সাধারণ মানুষের রান্নাঘর পর্যন্ত পৌঁছাবে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।