ব্যাংকে টাকা নেই: চেক হাতে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন গ্রাহকরা


“নিজের জমানো টাকা তুলতেও যদি জুতা ক্ষয় করতে হয়, তাহলে আর ব্যাংকে টাকা রেখে লাভ কী?”— তীব্র হতাশা নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন এক ভুক্তভোগী গ্রাহক। শুধু তিনি নন, এই প্রশ্ন এখন বন্দরনগরী চট্টগ্রামের হাজারো ব্যাংক গ্রাহকের, যারা নিজেদের প্রয়োজনে জমাকৃত অর্থ তুলতে গিয়ে পদে পদে হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

রাজধানীর মতো বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামেও তীব্র তারল্য সংকটে পড়েছে দেশের বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ধার নিয়েও সংকট কাটাতে পারছে না ব্যাংকগুলো। ফলে চট্টগ্রামের বিভিন্ন শাখায় টাকা তুলতে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা, কর্মকর্তাদের অসহযোগিতামূলক আচরণ এবং নানা অজুহাতে গ্রাহকদের ফিরিয়ে দেওয়ার ঘটনা এখন নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। চিকিৎসা, সন্তানের স্কুলের বেতন কিংবা ব্যবসার জরুরি প্রয়োজনেও টাকা না পেয়ে গ্রাহকদের মধ্যে বাড়ছে ক্ষোভ ও হাহাকার।

সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, গত বছরের ৫ই আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বেশ কয়েকটি ব্যাংকে আমানত তোলার যে হিড়িক পড়েছিল, সেই চাপ এখনো সামলে উঠতে পারেনি ব্যাংকিং খাত। বিশেষ করে বিতর্কিত ব্যবসায়ী মালিকানাধীন গ্লোবাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি, ইউনিয়ন, এক্সিম, পদ্মা, ন্যাশনাল ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের মতো ব্যাংকগুলোতে এই সংকট সবচেয়ে প্রকট। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ধার দিয়েও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেনি। মূলত লাগামহীন আর্থিক অনিয়ম ও তারল্য ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতার কারণেই গ্রাহকরা আজ নিজেদের আমানত ফেরত পাচ্ছেন না।

যদিও নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন, তবে রাজধানীর চিত্র থেকে চট্টগ্রামের পরিস্থিতি সহজেই অনুমেয়। শাখা থেকে শাখান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন হাজারো গ্রাহক, কিন্তু মিলছে কেবলই আশ্বাস।

রাজধানীর মতিঝিলে কবিরুল ইসলাম নামের এক গ্রাহক জানান, তিনি যে ব্যাংকে ২০০১ সাল থেকে সেবা নিচ্ছেন, সেই ব্যাংক এখন তাকে সপ্তাহে পাঁচ হাজার টাকাও দিতে পারছে না। আবার ন্যাশনাল ব্যাংকের এক অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা তার পেনশনের টাকা তুলতে এসে সকাল ১০টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত লাইনে দাঁড়িয়েও টাকা পাননি। কর্মকর্তারা কখনো বলছেন ‘সার্ভার ডাউন’, কখনো ‘ক্যাশে টাকা নেই’।

এই চিত্র চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ, জিইসি মোড়, চকবাজার বা খাতুনগঞ্জের শাখাগুলোতেও ভিন্ন নয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রামের এক ব্যবসায়ী জানান, “আমার ব্যবসা প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম। কর্মীদের বেতন দিতে পারছি না, কারণ ব্যাংকে টাকা থাকা সত্ত্বেও আমি তা তুলতে পারছি না। ৫০ হাজার টাকার চেক দিলে হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় ৫ হাজার টাকা আর বলা হয়, ‘আপাতত চলুন’।”

শুধু নগরীতেই নয়, জেলার বিভিন্ন উপজেলা শাখাগুলোতেও ভোগান্তি পৌঁছেছে চরমে। নবাবগঞ্জের বান্দুরা শাখায় সুফিয়া বেগম নামের এক নারী তার ১৫ লাখ টাকার আমানত তুলতে না পেরে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন।

টাকা দিতে না পেরে গ্রাহকদের রোষের মুখে পড়ছেন ব্যাংক কর্মকর্তারাও। গ্রাহককে কীভাবে সামলাবেন তা বুঝে উঠতে পারছেন না তারা। চট্টগ্রামের বেশ কিছু শাখায় গ্রাহক-কর্মকর্তা বাকবিতণ্ডা ও হাতাহাতির মতো অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রামের এক কর্মকর্তা বলেন, “আমাদের কিছুই করার নেই। প্রধান কার্যালয় থেকে টাকা না এলে আমরা গ্রাহককে দেবো কোথা থেকে?”

এই ভয়াবহ সংকট নিয়ে এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, “কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার দেওয়ার কারণে সংকট কিছুটা নিরসন হলেও ব্যাংকগুলোর খারাপ অবস্থা এখনো কাটেনি।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান কিছু ব্যাংকে তারল্য সংকটের কথা স্বীকার করে দ্রুত সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন। তবে সেই আশ্বাসে ভরসা রাখতে পারছেন না সাধারণ মানুষ।

সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের বক্তব্য এই সংকটকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, “ব্যাংক খাতের ৮০ শতাংশ অর্থ নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যা পুনর্গঠনের জন্য ৩৫ বিলিয়ন ডলার লাগবে বলে জানিয়েছে আইএমএফ।”

এই পরিস্থিতিতে, ‘ব্যাংকে জমা রাখা টাকা নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই’—বাংলাদেশ ব্যাংকের এই বার্তা চট্টগ্রামের সাধারণ আমানতকারীদের কাছে পরিহাসের মতো শোনাচ্ছে। তাদের একটাই প্রশ্ন—এই ভোগান্তির শেষ কবে?