অশ্রুসিক্ত রেললাইন: আর কত লাশের মিছিল দেখব আমরা?


চোখ বন্ধ করে একবার কল্পনা করুন তো। কক্সবাজারের রামু উপজেলার এক শান্ত দুপুর। একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা এগিয়ে চলেছে রেললাইন ধরে। ভেতরে এক মা তার দুই সন্তানকে নিয়ে বসে আছেন, হয়তো তাদের চোখেমুখে ছিল বাড়ি ফেরার আনন্দ অথবা কোনো নিকটজনের সাথে দেখা করার উত্তেজনা। চালকের আসনে বসা মানুষটিও হয়তো ভাবছিলেন দিনের শেষে পরিবারের জন্য কী নিয়ে যাবেন।

কিন্তু পরমুহূর্তেই এক ভয়াবহ শব্দ আর তীব্র ঝাঁকুনিতে সবকিছু তছনছ হয়ে গেল। ঢাকাগামী একটি দ্রুতগতির ট্রেন দানবের মতো এসে আছড়ে পড়ল অটোরিকশাটির ওপর। পিষে, দুমড়েমুচড়ে যাওয়া ধাতব কফিনটাকে ট্রেনটি ঠেলে নিয়ে গেল এক কিলোমিটারেরও বেশি পথ। ভেতরে থাকা পাঁচটি তাজা প্রাণ নিভে গেল এক নিমিষে। মা, দুই ছেলে, আরেকজন নিকটাত্মীয় এবং চালক—একটি পরিবার, একটি মুহূর্ত, একটি অবহেলা সবকিছু শেষ করে দিল।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া সেই ভিডিও যারা দেখেছেন, তারা জানেন এই মৃত্যু কতটা ভয়াবহ, কতটা মর্মান্তিক। এ দৃশ্য চোখে হারানো স্বজনের লাশের মতোই বীভৎস, এ দৃশ্য আমাদের বিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ করে, আমাদের অনুভূতিকে ভোঁতা করে দেয়।

এটি নিছক কোনো দুর্ঘটনা নয়। এটিকে দুর্ঘটনা বললে ভুল হবে, চরম ভুল। এটি একটি কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড। বছরের পর বছর ধরে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর চরম অবহেলা, সমন্বয়হীনতা আর উদাসীনতার ফলে যে মৃত্যুফাঁদ তৈরি হয়েছে, এ হলো তারই নির্মম শিকার। রামুর ধলিরছড়া রেলক্রসিংয়ের এই ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন কোনো চিত্র নয়, এটি বাংলাদেশের শত শত অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ের এক ভয়াল প্রতিচ্ছবি মাত্র। যে দেশে রেললাইনে দুর্ঘটনায় বছরে এক হাজারের বেশি মানুষ মারা যায় এবং যার ৮৩ শতাংশ মৃত্যুই ঘটে অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে, সে দেশে নাগরিকের জীবনের মূল্য ঠিক কতটা, তা সহজেই অনুমেয়।

প্রতিটি দুর্ঘটনার পর যা হয়, এবারও তাই হয়েছে। স্থানীয় মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে, একটি ট্রেন আটকে দিয়েছে, তাদের দাবি—অরক্ষিত ক্রসিংয়ে গেট চাই, গেটম্যান চাই। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষও তাদের চিরাচরিত নিয়ম মেনে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কিন্তু এই কমিটি, এই বিক্ষোভ, এই কান্না—সবকিছুই যেন এক অন্তহীন চক্রের অংশ। কিছুদিন পর সবাই ভুলে যাবে, নতুন কোনো দুর্ঘটনার অপেক্ষায় আমরা দিন গুনব। কিন্তু যে পরিবারটি ধ্বংস হয়ে গেল, তাদের শূন্যতা কে পূরণ করবে? যে শিশুরা তাদের মাকে হারাল, যে মা তার সন্তানদের হারালেন, তাদের জীবনের এই অপূরণীয় ক্ষতির দায় কে নেবে? রেল কর্তৃপক্ষ? সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর? নাকি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর?

বিড়ম্বনার বিষয় হলো, দায় নেওয়ার সংস্কৃতি আমাদের দেশে নেই বললেই চলে। রেল কর্তৃপক্ষ প্রায়শই বলে থাকে যে, অধিকাংশ সড়ক নির্মাণের সময় তাদের অনুমতি নেওয়া হয়নি, তাই দায় তাদের নয়। কিন্তু ২০১৯ সালের এক পরিসংখ্যান আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, রেলের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে তৈরি করা ‘বৈধ’ রেলক্রসিংয়েরও ৬১ শতাংশের বেশি অরক্ষিত, সেখানে কোনো গেট নেই, কোনো গেটম্যান নেই। গত ছয় বছরে এই পরিস্থিতির কি আদৌ কোনো উন্নতি হয়েছে? উত্তর আমাদের সবারই জানা। সড়ক ও রেল—উন্নয়নের এই দুই প্রধান হাতিয়ারের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এতটাই প্রকট যে, তা এখন সাধারণ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

একদিকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জোয়ারে আমরা ভাসছি, বড় বড় প্রকল্প আর অবকাঠামো নির্মাণে আমাদের আগ্রহের কমতি নেই। হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে আমরা সড়ক, সেতু আর রেলপথ নির্মাণ করছি। কিন্তু যে নাগরিকের জন্য এই উন্নয়ন, তার জীবনের নিরাপত্তার প্রশ্নে আমাদের এই সংস্থাগুলোর অনাগ্রহ দেখলে হতাশ হতে হয়। মনে হয়, যেন মানুষের জীবনের চেয়ে ইট-পাথরের কাঠামোর মূল্যই বেশি। প্রতিটি প্রকল্প যেনতেনভাবে শেষ করার তাগিদ যতটা, তার সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ততটাই শৈথিল্য। ফলে, রেলক্রসিংগুলো পরিণত হয়েছে মৃত্যুফাঁদে। আর এই ফাঁদে প্রতিনিয়ত প্রাণ দিচ্ছে সাধারণ, নিরীহ মানুষ।

রামুর ঘটনায় নিহতদের মুখগুলো যখন চোখের সামনে ভাসে, তখন প্রশ্ন জাগে—তাদের কি কোনো স্বপ্ন ছিল না? ওই মায়ের চোখে কি তার সন্তানদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো আশা ছিল না? চালকটিও তো কারো না কারো বাবা, ভাই বা সন্তান ছিলেন। তাদের জীবনের গল্পগুলো এক মুহূর্তের অবহেলায় থেমে গেল। এই মৃত্যুর জন্য দায়ী কে? শুধুমাত্র কি সেই ট্রেনচালক? নাকি সেই অটোরিকশাচালক? না, এই দায় আমাদের পুরো সিস্টেমের, আমাদের কাঠামোর। যে কাঠামো একজন নাগরিককে সামান্য নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়, সে কাঠামো নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি না।

যতদিন পর্যন্ত একজন সাধারণ নাগরিকের জীবন আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার কাছে অমূল্য বলে বিবেচিত না হবে, যতদিন পর্যন্ত প্রতিটি মৃত্যুকে সহজভাবে একটি সংখ্যা হিসেবে দেখা বন্ধ না হবে, ততদিন এই অশ্রুসিক্ত রেললাইন লাশের মিছিল দেখতেই থাকবে। ততদিন আমাদের মায়েরা সন্তান হারাবে, সন্তানরা এতিম হবে। আর আমরা কলাম লিখব, তদন্ত কমিটি হবে, কিন্তু কিছুই বদলাবে না।

এই কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হলে প্রয়োজন সদিচ্ছা, সমন্বয় এবং কঠোর দায়বদ্ধতা। প্রতিটি মৃত্যুকে জাতীয় শোক হিসেবে গণ্য করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। নতুবা, রামুর এই কান্না, এই আহাজারি সময়ের অতলে হারিয়ে যাবে, আরেকটি নতুন ট্র্যাজেডির অপেক্ষায়।

প্রশ্ন হলো, আর কত মৃত্যু আমাদের বিবেককে জাগিয়ে তোলার জন্য প্রয়োজন? আর কত মায়ের কোল খালি হলে আমাদের টনক নড়বে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা নেই, আর হয়তো এই কারণেই আমাদের চোখ আজ ভিজে আসে, আর হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।