সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড: বিচারহীনতার এই লজ্জা কার?


আবারও সেই একই লজ্জা, একই প্রহসন। আরও একবার আদালতের বারান্দায় প্রতিধ্বনিত হলো বিচারহীনতার করুণ প্রতিধ্বনি। সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ আবারও পিছিয়েছে। গুনে গুনে ১২০ বার! ভাবা যায়? একটি সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য এর চেয়ে বড় লজ্জার আর কী হতে পারে? মঙ্গলবার (১১ আগস্ট) ঢাকার মহানগর হাকিম আদালত যখন আগামী ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়িয়ে দিলেন, তখন মনে হচ্ছিল, আমাদের বিচার ব্যবস্থার কপালে যেন আরও একবার কলঙ্কের তিলক এঁকে দেওয়া হলো। এই অন্তহীন অপেক্ষা আর কতকাল চলবে?

আজ থেকে তেরো বছরেরও বেশি সময় আগে, ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি, দেশের গণমাধ্যম কর্মীরা এক বিভীষিকাময় সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠেছিলেন। আমাদের সহকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সারোয়ার এবং এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনিকে তাদেরই ভাড়া করা বাসার বেডরুমে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। তাদের একমাত্র শিশু সন্তান মেঘ তখন মায়ের রক্তাক্ত লাশের পাশে বসে কাঁদছিল। সেই কান্নার শব্দ কি রাষ্ট্রযন্ত্রের কানে পৌঁছায়নি? মেঘের সেই আর্তনাদ কি আজও দেশের বিবেককে দংশন করে না?

এই হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সদম্ভে ঘোষণা দিয়েছিলেন, “৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের শনাক্ত করে জাতির সামনে হাজির করা হবে।” সেই ৪৮ ঘণ্টা পেরিয়ে তেরো বছর পার হয়ে গেছে। প্রায় সাড়ে চার হাজার দিন! কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন কোথায়? খুনিরা তো দূরের কথা, তদন্ত প্রতিবেদনই আলোর মুখ দেখেনি। সময়ের স্রোতে মন্ত্রীর পর মন্ত্রী বদল হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়ে নতুন সরকার এসেছে, তদন্তকারী সংস্থাও বারবার পরিবর্তিত হয়েছে – শেরেবাংলা নগর থানা থেকে গোয়েন্দা পুলিশ, তারপর দেশের চৌকস বাহিনী হিসেবে পরিচিত র‍্যাব, এবং অবশেষে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। কিন্তু ফলাফলের খাতাটি আজও শূন্য।

এই দীর্ঘ সময়ে আমরা কী দেখিনি? আটজনকে গ্রেপ্তার করা হলো, তাদের মধ্যে দুজন আবার জামিনেও বেরিয়ে গেল। ঘটনাস্থল থেকে সংগৃহীত আলামত, ডিএনএ পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অত্যাধুনিক ল্যাবে পাঠানো হলো। কোটি টাকা খরচ হলো। কিন্তু সেই পরীক্ষার ফলাফল কী, তা আজও দেশবাসী জানতে পারল না। মনে হচ্ছে এই প্রমাণ আমলাতন্ত্র এবং উদাসীনতার অতল গহ্বরে অদৃশ্য হয়ে গেছে।

গত বছর মহামান্য হাইকোর্ট এই তদন্তের স্থবিরতায় অসন্তোষ প্রকাশ করে র‍্যাবকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন। একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্স গঠন করে ছয় মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। সেই টাস্কফোর্সের অধীনেই এখন পিবিআই কাজ করছে। আমাদের মনে এক মুহূর্তের জন্য আশার সঞ্চার হয়েছিল। আমরা ভেবেছিলাম, এবার বুঝি ন্যায়বিচারের সূর্য উঠবে। আইনজীবী শিশির মনির যখন বলছিলেন, তদন্ত ‘অনেকদূর’ এগিয়েছে, তখন আমরা আশায় বুক বেঁধেছিলাম। কিন্তু ১২০ বারের মতো তারিখ পেছানোর পর সেই আশা এখন তীব্র হতাশায় নিমজ্জিত। এই ‘অনেকদূর’ পথ আসলে কতদূর? এর শেষ কোথায়?

প্রতিবার যখন প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ আসে, আমরা সাংবাদিক সমাজ, সাগরের পরিবার, রুনির পরিবার একবুক আশা নিয়ে আদালতের দিকে তাকিয়ে থাকি। কিন্তু প্রতিবারই আমাদের হতাশ হতে হয়। এই হতাশা এখন ক্ষোভে পরিণত হয়েছে। এই ক্ষোভ শুধু একটি মামলার বিচার না পাওয়ার ক্ষোভ নয়; এই ক্ষোভ রাষ্ট্রের প্রতি, বিচার ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা হারানোর ক্ষোভ। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড শুধু দুটি প্রাণের নৃশংস অবসান নয়, এটি বাংলাদেশের গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করার এক ঘৃণ্য প্রচেষ্টার প্রতীক। এটি একটি বার্তা দেওয়ার চেষ্টা যে, সত্য কথা বললে, সততার সাথে সাংবাদিকতা করলে, তার পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ।

এই দীর্ঘ তেরো বছরে মেঘ তার বাবা-মাকে ছাড়াই শৈশব-কৈশোর পার করছে। তাকে কী জবাব দেবে এই রাষ্ট্র? নওশের আলম রোমান, রুনির ভাই, যিনি এই মামলার বাদী, তিনি বিচার পাওয়ার আশায় দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। তার এই লড়াইয়ের শেষ কোথায়? সাগর-রুনির সহকর্মীরা, আমরা যারা তাদের সাথে কাজ করেছি, তাদের হাসিমুখ আজও আমাদের স্মৃতিতে অমলিন। সেই স্মৃতি বুকে নিয়ে আমরা আর কতদিন বিচারের জন্য রাজপথে দাঁড়াবো?

এই মামলাটি এখন আর শুধু একটি হত্যা মামলা নয়, এটি আমাদের বিচার ব্যবস্থার জন্য একটি লিটমাস টেস্ট। এই মামলার বিচার সম্পন্ন করতে না পারাটা রাষ্ট্রের চরম ব্যর্থতার পরিচায়ক। এই ব্যর্থতা আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভেতর থেকে ক্ষয় করে দিচ্ছে। আমরা কার কাছে বিচার চাইব? যখন রাষ্ট্র নিজেই তার নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে এবং অপরাধের বিচার করতে ব্যর্থ হয়, তখন আস্থার জায়গাটি কোথায় থাকে?

আমরা তীব্র ক্ষোভ ও ধিক্কার জানাই এই অন্তহীন বিচারিক দীর্ঘসূত্রতার প্রতি। আমরা কোনো অজুহাত শুনতে চাই না। আমরা কোনো কালক্ষেপণ দেখতে চাই না। আমরা চাই, আগামী ১৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যেই যেনতেন প্রকারে এই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হোক এবং একটি স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খুনিদের মুখোশ উন্মোচন করা হোক। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হোক।

অন্যথায়, এই ১২০ বারের লজ্জা আমাদের জাতীয় বিবেকের ওপর এমন এক দগদগে ঘা হয়ে থাকবে, যা কোনোদিন শুকাবে না। সাগর-রুনির আত্মা এবং তাদের সন্তানের কাছে আমাদের যে দায়, সেই দায় শোধ করার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্র কি তার নাগরিকের প্রতি এই ন্যূনতম দায়িত্বটুকু পালন করবে? নাকি এই মামলাটিও হারিয়ে যাবে বিস্মৃতির অতল গহ্বরে, বিচারহীনতার আরও একটি কালো অধ্যায় হয়ে? আমরা অপেক্ষায় থাকলাম, আরও একবার, হয়তো শেষবারের মতো।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।