
অনাহার কী? এটি কোনো আকস্মিক মৃত্যু নয়। এটি এক দীর্ঘ, যন্ত্রণাদায়ক প্রক্রিয়া, যেখানে শরীর নিজেই নিজেকে খেয়ে ফেলে। খাদ্যের অভাবে প্রথমে যকৃতে জমে থাকা শেষ শর্করাটুকুই সম্বল হয়। এরপর শরীর তার বেঁচে থাকার আদিম তাড়নায় মস্তিষ্ক আর হৃৎপিণ্ডকে বাঁচিয়ে রাখতে শুরু করে নিজের মাংস আর চর্বি গলানোর এক নির্মম প্রক্রিয়া। টিস্যুগুলো ভেঙে পড়তে থাকে, পেশি শুকিয়ে যায়। একসময় সেই ভান্ডারও যখন শূন্য হয়ে আসে, তখন হৃৎপিণ্ড ক্লান্ত হয়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আত্মসমর্পণ করে। চামড়াগুলো তখন কঙ্কালের ওপর লেপ্টে থাকা এক পাতলা আস্তরণে পরিণত হয়, প্রতিটি নিঃশ্বাস হয়ে ওঠে এক দুঃসহ বোঝা। একে একে নিভে আসে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের আলো, দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে আসে। ফাঁপা শরীরটা তখন এক জীবন্ত লাশ হয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে।
এই বৈজ্ঞানিক সত্যের নির্মম মঞ্চায়ন আজ আমরা দেখছি গাজার মাটিতে। টেলিভিশনের পর্দায়, মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে ওঠা কঙ্কালসার শিশুদের ছবিগুলো কোনো দূর অতীতের দুর্ভিক্ষের নয়, এগুলো আমাদের এই বর্তমান পৃথিবীর—আমাদের এই সভ্যতারই প্রতিচ্ছবি। মায়ের কোলে এক ফোঁটা দুধের জন্য ছটফট করতে করতে নিস্তেজ হয়ে যাওয়া নবজাতকের মুখ, ক্ষুধার্ত চোখ মেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা শিশুর চাহনি আমাদের সম্মিলিত বিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। আর এই চরম মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যেই ইসরায়েল তার যুদ্ধের তীব্রতা আরও বাড়িয়েছে। গাজা সিটি ‘দখল’ করার নামে তারা শুরু করেছে নতুন অভিযান, যার অর্থ আরও মৃত্যু, আরও ধ্বংস এবং আরও গভীর অনাহার।
জাতিসংঘের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা রমেশ রাজাসিংহাম নিরাপত্তা পরিষদে দাঁড়িয়ে যে সত্য উচ্চারণ করেছেন, তা আমাদের আত্মাকে কাঁপিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। তিনি বলেছেন, ‘এটি আর ভবিষ্যতের দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি নয়, এটি সরাসরি অনাহারে মানুষ মেরে ফেলা।’ কথাটি স্পষ্ট: গাজায় যা ঘটছে, তা কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটি একটি ইচ্ছাকৃত প্রক্রিয়া। এটি এক পরিকল্পিত গণহত্যা, যেখানে বুলেট বা বোমার বদলে ক্ষুধা আর তৃষ্ণাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। দুর্ভিক্ষবিশেষজ্ঞ অ্যালেক্স ডি ওয়ালের কথাগুলো আরও মর্মান্তিক। তিনি জানাচ্ছেন, গাজার হাজার হাজার শিশু এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে, এখন অলৌকিকভাবে খাবার পেলেও তারা বাঁচবে না। তাদের শরীর এখন আর খাবার হজম করার ক্ষমতা রাখে না। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আমরা এমন এক পরিস্থিতির সাক্ষী হচ্ছি, যেখানে মানুষ শুধু খাবারের অভাবে নয়, খাবার পেয়েও খেতে না পারার মতো এক চরম অসহায়ত্বের মধ্যে মারা যাচ্ছে।
এই অপরাধের সূচনা হয়েছিল ২০২৩ সালের ৯ অক্টোবর, যখন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট এক অমানবিক ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি গাজা উপত্যকায় পূর্ণ অবরোধের নির্দেশ দিয়েছি। সেখানে কোনো বিদ্যুৎ থাকবে না, খাবার থাকবে না, জ্বালানি থাকবে না। আমরা মানবপশুর সঙ্গে যুদ্ধ করছি এবং সে অনুযায়ী কাজ করব।’ এই একটি ঘোষণাই ছিল আন্তর্জাতিক আইনের গালে এক চপেটাঘাত। একটি সম্পূর্ণ জনগোষ্ঠীকে ‘মানবপশু’ আখ্যা দিয়ে সেখানে বেসামরিক আর যোদ্ধার পার্থক্য মুছে দেওয়া হয়েছিল। শুরু হয়েছিল এক সম্মিলিত শাস্তির প্রক্রিয়া, যা টানা ৭০ দিন ধরে গাজাকে বাকি বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল।
আন্তর্জাতিক আইন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে, যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে অনাহারকে ব্যবহার করা একটি গুরুতর যুদ্ধাপরাধ। দখলদার শক্তি হিসেবে ইসরায়েলের আইনি বাধ্যবাধকতা ছিল গাজার বেসামরিক মানুষের জন্য খাদ্য, পানি ও ওষুধের সরবরাহ নিশ্চিত করা। কিন্তু গত ২১ মাস ধরে বিশ্ব দেখেছে ঠিক তার উল্টো চিত্র। বিভিন্ন দেশ ও মানবাধিকার সংস্থা যখন সাহায্যের হাত বাড়াতে চেয়েছে, ইসরায়েল বারবার তাতে বাধা দিয়েছে। মানবিক সাহায্য পৌঁছানোর অনুমতি দেওয়া তাদের জন্য কোনো করুণা নয়, বরং এটি তাদের আইনি দায়িত্ব ছিল। কিন্তু তারা সেই দায়িত্ব পালন না করে ত্রাণকর্মী এবং ত্রাণবাহী কনভয়ের ওপর হামলা চালিয়েছে।
এর চেয়েও লজ্জার বিষয় হলো বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলোর ভূমিকা। যখন গাজায় ইচ্ছাকৃতভাবে অনাহার চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছিল, তখন অনেক সরকারই নির্লজ্জভাবে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তারা অজুহাত দিয়েছে, সাহায্য নাকি হামাসের হাতে চলে যাচ্ছে—এমন এক অভিযোগ, যার কোনো শক্ত প্রমাণ ইসরায়েলও কখনো দিতে পারেনি। বরং এই অজুহাতের আড়ালে ওইসব সরকার গাজায় সাহায্য পাঠানোর তুলনায় ইসরায়েলকে হাজার গুণ বেশি অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহ করেছে। তারা গণহত্যা প্রতিরোধ এবং থামানোর যে নৈতিক ও আইনি দায়িত্ব ছিল, তাতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
ইতিহাস এই মুহূর্তকে এক চিরস্থায়ী বৈশ্বিক লজ্জা হিসেবে মনে রাখবে। অ্যানা ফ্রাঙ্কের ডায়েরির মতো, আইলান কুর্দির নিথর দেহের মতো, গাজার এই কঙ্কালসার শিশুদের ছবিগুলোও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমাদের ব্যর্থতার দলিল হয়ে থাকবে। এই ছবিগুলো অতীতের সেইসব মুহূর্তের পাশেই জায়গা করে নেবে, যখন পৃথিবী অসহায় মানুষের জন্য কিছুই করেনি।
এখনও কি জেগে ওঠার সময় হয়নি? মানবতার শেষ আলোটুকু বাঁচিয়ে রাখার জন্য আর কত শিশুর মৃত্য দেখতে হবে আমাদের? উত্তর গাজায় যখন পূর্ণমাত্রার দুর্ভিক্ষ চলছে, তখন প্রতিটি মুহূর্তের নিষ্ক্রিয়তা মানে আরও কিছু নিষ্পাপ প্রাণের প্রদীপ নিভে যাওয়া। যদি এখনই কিছু করা না যায়, তবে আরও অসংখ্য শিশু তাদের ক্ষুধার্ত, প্রশ্নবিভর চোখ মেলে আমাদের দিকে তাকিয়েই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। আর সেই চাহনির দায়ভার এই পৃথিবীর প্রতিটি বিবেকবান মানুষকে বয়ে বেড়াতে হবে, চিরকাল।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।
