
মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ১২ লাখ রোহিঙ্গার ভবিষ্যৎ নিয়ে ঘনিয়ে আসছে অশনি সংকেত। তাদের খাদ্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার প্রধান জোগানদাতা যুক্তরাষ্ট্র এক বছরের ব্যবধানে মানবিক সহায়তা অর্ধেকেরও বেশি কমিয়ে দিয়েছে। এর সরাসরি প্রভাবে ইতোমধ্যে রোহিঙ্গা শিশুদের কয়েক হাজার স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে এবং আগামী নভেম্বর থেকে খাদ্য সহায়তায় ভয়াবহ সংকট তৈরির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জাতিসংঘের মানবিক কার্যক্রম সমন্বয় সংস্থার (ওসিএইচএ) তথ্যমতে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে আসা মোট মানবিক সহায়তার ৫২.৭ শতাংশ (৩৫ কোটি ৬৭ লাখ ডলার) দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু চলতি বছরের ২২ আগস্ট পর্যন্ত আসা মোট তহবিলের মাত্র ২৩.৭ শতাংশ (৮ কোটি ৫৩ লাখ ডলার) দেশটি থেকে এসেছে। এই বিপুল অঙ্কের তহবিল ঘাটতি বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী শিবিরের ব্যবস্থাপনাকে খাদের কিনারে দাঁড় করিয়েছে।
খাদ্য ও শিক্ষায় ভয়াবহ প্রভাব
সহায়তা কমে যাওয়ায় সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে খাদ্য ও শিক্ষা খাতে। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান, “যুক্তরাষ্ট্রের ফান্ডের ৮০ শতাংশের বেশি আসে খাদ্য সহায়তায়। মনে হচ্ছে এ বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বর থেকে সেটি বড় ধরনের সংকটে পড়বে।” বর্তমানে মাথাপিছু মাসিক ১২ ডলার খাদ্য সহায়তা দেওয়া হলেও নভেম্বরের পর বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (WFP) তা আরও কমাতে বাধ্য হতে পারে। এতে অপুষ্টি ও স্বাস্থ্যঝুঁকি, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের মধ্যে মারাত্মক আকার ধারণ করবে।
এরই মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রমে ধস নেমেছে। ইউনিসেফের নেতৃত্বে পরিচালিত সাড়ে তিন লাখ শিশুর জন্য শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এসব শিশুর ভবিষ্যৎ অন্ধকার। কমিশনার বলেন, “৫০ শতাংশের বেশি স্কুল এখন বন্ধ। হোস্ট কমিউনিটির শিক্ষকদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।”
বাড়ছে অপরাধ ও অস্থিরতা
তহবিল সংকটের কারণে কেবল ক্ষুধা ও শিক্ষার অভাবই নয়, শরণার্থী শিবিরে বাড়ছে সামাজিক অস্থিরতা ও অপরাধপ্রবণতা। রোহিঙ্গা অ্যাক্টিভিস্ট ইউনূস আরমানের ভাষায়, “মানুষ খাদ্য না পেলে কাজের খোঁজে ক্যাম্পের বাইরে যাবে, যা স্থানীয়দের সঙ্গে সংঘাত বাড়াবে। অনেক মাদক কারবারি হতাশ তরুণদের মাদক বহনের কাজে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। ফান্ড না এলে সামনে এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে।”
এনজিওগুলোর কার্যক্রম সীমিত হয়ে আসায় দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ বন্ধ হয়ে গেছে, যা রোহিঙ্গা তরুণদের হতাশার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
এনজিওগুলোর কার্যক্রম সংকুচিত, ভবিষ্যতে গভীর সংকট
দেশের অন্যতম শীর্ষ বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ্ জানান, চলতি বছরের প্রতিশ্রুতি থাকায় তাদের কার্যক্রম এখনো চলছে। তবে তার আশঙ্কা, “আগামী বছরের প্রতিশ্রুতি সেপ্টেম্বরের মধ্যে হওয়ার কথা। সেখানে বড় একটা ঘাটতি পড়তে পারে। সমগ্র রোহিঙ্গা সহায়তার প্রায় ৪০ শতাংশ আসে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে। তারা যদি সহায়তা না করে, যার সমূহ সম্ভাবনা আছে—তাহলে এর ফল হবে ভয়াবহ।”
সংকট সমাধানে সরকারের উদ্যোগ
এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা জোরদার করেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্যোগে রোহিঙ্গা ইস্যুতে তিনটি বড় আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এর প্রথমটি আজ কক্সবাজারে শুরু হচ্ছে। এরপর নিউইয়র্ক ও দোহায় আরও দুটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে, যেখানে রোহিঙ্গারা সরাসরি তাদের সমস্যা ও আকাঙ্ক্ষার কথা তুলে ধরার সুযোগ পাবেন।
শরণার্থী বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর মনে করেন, “আজকের সম্মেলনের মাধ্যমে সংকটের হালনাগাদ চিত্র উঠে আসবে, যা আসন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অর্থ সহায়তা পুনর্বিন্যাসে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।”
দৃষ্টি ফেরাচ্ছে পশ্চিমারা?
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, ইউক্রেন যুদ্ধ ও মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতের কারণে পশ্চিমা দেশগুলোর মনোযোগ ও অর্থ উভয়ই এখন সেদিকে। ফলে রোহিঙ্গা ইস্যুটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অগ্রাধিকার তালিকা থেকে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা অন্য দাতা দেশগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানালেও তা প্রয়োজনের তুলনায় সামান্যই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া কেবল মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভর করে এই দীর্ঘস্থায়ী সংকটের সমাধান সম্ভব নয়। আর তার আগ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সহায়তাই বাংলাদেশে আটকে থাকা এই জনগোষ্ঠীর জীবন বাঁচানোর একমাত্র অবলম্বন।
