শুধু শরণার্থী নয়, বাংলাদেশ যে বিশাল নিরাপত্তা ঝুঁকির ওপর বসে আছে!


কক্সবাজারের উখিয়ার একটি হাসপাতালের প্রসূতি ওয়ার্ড। সেখানে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ জন রোহিঙ্গা নারী সন্তান জন্ম দিচ্ছেন। এই ছবিটি প্রথম দৃষ্টিতে জীবনের জয়গান বলে মনে হতে পারে, কিন্তু পর্দার আড়ালের সত্যটি ভিন্ন। এই নবজাতকদের আগমন কোনো আনন্দবার্তা নয়, বরং এক প্রলম্বিত সংকটের গভীর থেকে গভীরতর হওয়ার সতর্কঘণ্টা। তাদের মায়েরা অনেকেই অপ্রাপ্তবয়স্ক, অপুষ্টির শিকার। তাদের জন্মই হচ্ছে এক অনিশ্চয়তার মাঝে, এক রাষ্ট্রহীন পরিচয় নিয়ে।

আট বছর ধরে যখন একজন রোহিঙ্গাকেও স্বদেশে ফেরত পাঠানো যায়নি, আন্তর্জাতিক সহায়তা যখন তলানিতে এবং নতুন করে যখন অনুপ্রবেশের স্রোত থামছে না, তখন এই বিপুল সংখ্যক নবজাতকের জন্ম রোহিঙ্গা সংকটকে এক নতুন এবং সম্ভবত আরও জটিল অধ্যায়ে ঠেলে দিচ্ছে।

একটি মানবিক সংকট কতটা বহুমাত্রিক রূপ নিতে পারে, রোহিঙ্গা পরিস্থিতি তার এক নির্মোহ উদাহরণ। আমরা প্রায়শই প্রত্যাবাসন, আন্তর্জাতিক কূটনীতি এবং ক্যাম্পের নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা করি, কিন্তু এর ভেতরে নীরবে যে একটি জনসংখ্যাগত বিস্ফোরণ ঘটছে, তা অনেক সময়ই আড়ালে থেকে যায়।

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের তথ্যমতে, প্রতি বছর ৩২ হাজার শিশু জন্ম নেওয়ার ফলে রোহিঙ্গা জনসংখ্যা এখন ১৩ লাখে পৌঁছেছে। এটি শুধু একটি সংখ্যা নয়, এটি একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর টিকে থাকার আকুতি, যার ভার বহন করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।

ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের ডা. কাজী গোলাম রসুল যে চিত্র তুলে ধরেছেন, তা ভয়াবহ। অপ্রাপ্তবয়স্ক ও অপুষ্টিতে ভোগা মায়েরা যখন সন্তান জন্ম দিচ্ছেন, তখন আমরা শুধু একটি শিশুর জন্ম দেখছি না, দেখছি একটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শুরু, যার স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও মানসিক বিকাশের ভিত্তিটাই নড়বড়ে। ক্যাম্পগুলোতে বাল্যবিয়ে যখন একটি সাধারণ ঘটনা, তখন বুঝতে হবে এই জনসংখ্যা বৃদ্ধি কোনো স্বাভাবিক প্রক্রিয়া নয়, বরং এটি হতাশা, শিক্ষার অভাব এবং ভবিষ্যতের প্রতি আস্থাহীনতার এক করুণ প্রকাশ।

এই সংকটের সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছে শিশুরা। আন্তর্জাতিক রেসকিউ কমিটির তথ্য অনুযায়ী, তহবিলের অভাবে ১২ বছরের কম বয়সী প্রায় পাঁচ লাখ শিশু আজ শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। ক্যাম্পের অনানুষ্ঠানিক স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমরা একটি আস্ত প্রজন্মকে বেড়ে উঠতে দেখছি, যাদের অক্ষরজ্ঞান নেই, ভবিষ্যতের কোনো স্বপ্ন নেই এবং রাষ্ট্রীয় কোনো পরিচয় নেই। এই শিশুরা যখন কৈশোরে পৌঁছাবে, তখন তাদের হতাশা, বঞ্চনা এবং পরিচয়হীনতার সংকট কোন পথে ধাবিত হবে, তা সহজেই অনুমেয়। অপরাধ, মাদক চোরাচালান এবং উগ্রবাদে ঝুঁকে পড়ার জন্য এর চেয়ে উর্বর ক্ষেত্র আর কী হতে পারে?

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যখন তহবিলের জোগান কমিয়ে দিয়ে তাদের দায়িত্ব সারছে, তখন তারা হয়তো বুঝতে পারছে না যে, আজকের সাশ্রয় আগামী দিনের জন্য এক বিশাল নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করছে, যার প্রভাব শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো অঞ্চলের ওপর পড়বে।

সংকটের অন্য পিঠে রয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ‘সহানুভূতি ক্লান্তি’ এবং মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় ঔদাসীন্য। আট বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত না নেওয়াটা মিয়ানমারের সদিচ্ছার অভাবকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে। উল্টো রাখাইনে চলমান সংঘাতের কারণে ২০২৪ সাল থেকেই নতুন করে সোয়া লাখ রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে, যা প্রমাণ করে সমস্যার মূল কারণটি আগের মতোই জ্বলজ্বল করছে।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার আবু সালেহ মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহর এই তথ্যটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, বাংলাদেশ একাই এই ভার আর কতদিন বইবে? একদিকে নতুন করে আসা মানুষের চাপ, অন্যদিকে পুরনোদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি—দুইয়ে মিলে কক্সবাজারের স্থানীয় পরিবেশ, অর্থনীতি ও সামাজিক ভারসাম্যের ওপর যে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।

এই গভীর হতাশার মাঝে এক টুকরো আশার আলো হয়ে এসেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সক্রিয় সম্পৃক্ততা। তার সাত দফা প্রস্তাবনা এবং আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে একটি নতুন কূটনৈতিক গতি সঞ্চারের চেষ্টা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বছরের পর বছর ধরে জমে থাকা এই জটিল জট কি কেবল সদিচ্ছা দিয়ে খোলা সম্ভব? মিয়ানমারের ওপর কার্যকর চাপ প্রয়োগে ব্যর্থ হয়েছে জাতিসংঘসহ বিশ্বের তাবড় শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো। সেখানে একটি নতুন সরকার রাতারাতি কী পরিবর্তন আনতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। তবে এই উদ্যোগ জরুরি ছিল, কারণ এটি অন্তত বিশ্ব ফোরামে মরে যাওয়া আলোচনাকে নতুন করে প্রাণ দেবে।

শেষ পর্যন্ত, রোহিঙ্গা সংকট এখন আর শুধু আশ্রয়প্রার্থীদের মানবিক সমস্যা নয়। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি অস্তিত্বের সংকট এবং বিশ্বের জন্য একটি নৈতিক পরীক্ষা। উখিয়ার হাসপাতালের আঁতুড়ঘরে যে শিশুটি আজ জন্ম নিচ্ছে, সে কোনো পাপ করেনি। তার রাষ্ট্রহীন, পরিচয়হীন জীবনের দায়ভার আমাদের সবার।

মানবিকতার খাতিরে আমরা তাদের আশ্রয় দিয়েছি, কিন্তু শুধু আশ্রয় আর ত্রাণ দিয়ে এই সমস্যার সমাধান হবে না। প্রয়োজন কঠোর কূটনৈতিক বাস্তবতা, মিয়ানমারের ওপর সমন্বিত আন্তর্জাতিক চাপ এবং এই জনগোষ্ঠীর জন্য একটি টেকসই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। অন্যথায়, ক্যাম্পের এই নতুন প্রজন্ম একদিন বাংলাদেশের জন্য আশার আলো নয়, বরং এক গভীর সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।