একই অর্থনীতির দুই ভিন্ন চেহারা


সরকারি নীতি নির্ধারক এবং দেশের শীর্ষস্থানীয় এক গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের চোখে বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থিতিশীলতার পথে হাঁটছে। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার স্থির হয়েছে, রিজার্ভ ধীরে ধীরে বাড়ছে এবং ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের বাতাস বইতে শুরু করেছে। মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে বাংলাদেশ ব্যাংক যে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করেছে, তা কষ্টকর হলেও ‘সঠিক পথ’ বলেই বিবেচিত হচ্ছে।

কিন্তু এই সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ছবির ঠিক উল্টো পিঠে রয়েছে এক গভীর সংকটের চিত্র। যেখানে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ধুঁকছে, প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলো লোকসান গুনছে, তরুণেরা বেকারত্বের অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে এবং সামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) আয়োজিত এক সেমিনারে উঠে আসা এই দুই বিপরীতধর্মী চিত্র আমাদের অর্থনীতি নিয়ে এক জটিল প্রশ্নের সামনে দাঁড় করায়—গুটিকয়েক পরিসংখ্যানের উন্নতিই কি একটি অর্থনীতির সঠিক পথে থাকার প্রমাণ, যখন তার চালিকাশক্তির একটি বড় অংশ ভেঙে পড়ছে?

পিআরআই এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, গত এক বছরের চেষ্টায় অর্থনীতির অনেক সূচকে স্বস্তি ফিরেছে। দুই বছর ধরে চলা উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি এবং রিজার্ভের পতন থামাতে যেসব কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, সেগুলোর সুফল এখন দৃশ্যমান। বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকাটা নিঃসন্দেহে একটি বড় সাফল্য। রিজার্ভের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়াটাও অর্থনীতির ব্যবস্থাপকদের আত্মবিশ্বাস জোগাচ্ছে।

ব্যাংকিং খাতের সংস্কারের অংশ হিসেবে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পথে হাঁটছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যার জন্য প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার একটি বিশাল অঙ্কের জোগান বন্ড ও বৈদেশিক সহায়তার মাধ্যমে করার পরিকল্পনা চলছে। মুদ্রাস্ফীতিকে ১০ শতাংশের ওপর থেকে ৪-৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়ে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি আরও কিছুদিন বহাল রাখার ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে। পিআরআইয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ আশিকুর রহমানের মতে, অর্থ পাচারের অন্যতম মাধ্যম মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির পরিমাণ কমে আসাও একটি ইতিবাচক দিক হতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে এই চিত্রগুলো নির্দেশ করে যে, দীর্ঘ অসুস্থতার পর অর্থনীতি সেরে ওঠার প্রাথমিক লক্ষণ দেখাচ্ছে।

কিন্তু এই আশাব্যঞ্জক ছবির আড়ালে যে আরেকটি অন্ধকার জগৎ রয়েছে, তার নির্মম বর্ণনা দিয়েছেন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রির (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ। তাঁর কথায়, পোশাক খাতের প্রবৃদ্ধি দিয়ে পুরো অর্থনীতির স্বাস্থ্য বিচার করা একটি বড় ভুল। দেশের শিল্প খাত, বিশেষ করে কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) রীতিমতো ‘রুগ্‌ণ’ হয়ে পড়েছে। একের পর এক খুচরা দোকান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ৩৫ বছরের ইতিহাসে প্রথমবার লোকসানের মুখ দেখেছে বাটার মতো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান। সিঙ্গার লোকসান করেছে। বহু প্রতিষ্ঠানের বিক্রি আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে। এর ফল কী?

এসব শিল্পের সঙ্গে জড়িত বহু মানুষ জীবিকা হারিয়ে হতাশায় আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব বাড়ছে, যা তাদের ঠেলে দিচ্ছে চুরি, ডাকাতি ও রাহাজানির মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের দিকে। এই সংকটকে তিনি চার-পাঁচ বছর আগের গ্যাস সংকট থেকে শুরু হওয়া এক দীর্ঘমেয়াদী সমস্যার ফল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যেখানে শিল্পমালিকেরা বাড়তি দাম দিয়েও নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি পাচ্ছেন না।

এই দুই চিত্রকে পাশাপাশি রাখলে বোঝা যায়, সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা অর্জনের জন্য যে নীতি গ্রহণ করা হয়েছে, তার চাপ গিয়ে পড়ছে দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির ওপর। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির অর্থ হলো বাজারে টাকার প্রবাহ কমানো এবং ঋণের সুদহার বৃদ্ধি। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে বিনিয়োগ ও ভোগ ব্যয়ের ওপর। যখন সুদের হার বাড়ে, তখন উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণ নিয়ে ব্যবসা সম্প্রসারণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।

অন্যদিকে, মানুষের হাতেও খরচ করার মতো টাকার পরিমাণ কমে যায়। ফলে বাজারের সামগ্রিক চাহিদা সংকুচিত হয়। বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো হয়তো এই ধাক্কা সাময়িক সময়ের জন্য সামলে নিতে পারে, কিন্তু দেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি হিসেবে পরিচিত সিএমএসএমই খাতের জন্য এই পরিস্থিতি মরণকামড়ের শামিল। তাদের পুঁজি কম, টিকে থাকার ক্ষমতা সীমিত। চাহিদা কমে যাওয়ায় তাদের উৎপাদিত পণ্য অবিক্রীত থাকছে, আর উচ্চ সুদের কারণে ব্যাংকঋণও নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। ফলে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় থাকছে না।

এখানেই নীতি নির্ধারকদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রক্ষা করা নিঃসন্দেহে জরুরি। কিন্তু সেই নীতির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় যদি দেশের লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী খাতগুলোই ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে সেই স্থিতিশীলতার ভিত্তি কতটা মজবুত থাকে? পিআরআইয়ের বিশ্লেষণেও উঠে এসেছে যে, মুদ্রাস্ফীতির হারের তুলনায় মজুরি বৃদ্ধির হার কম থাকায় দেশে দারিদ্র্য বাড়ছে। অর্থাৎ, মানুষ শুধু চাকরি হারাচ্ছে না, যাদের চাকরি আছে তাদেরও প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে গিয়ে তারা হিমশিম খাচ্ছে, যা সামগ্রিক অর্থনীতিতে চাহিদার সংকটকে আরও তীব্র করে তুলছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ আখতার হোসেন কর্মসংস্থান বাড়াতে বিদেশি বিনিয়োগের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন, কারণ দেশের স্থানীয় সঞ্চয় কম। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যে দেশে অভ্যন্তরীণ চাহিদা সংকুচিত, জ্বালানি সংকটের সমাধান নেই এবং ক্ষুদ্র শিল্পগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, সেখানে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কতটা আস্থা পাবেন? অর্থনীতির গতি বাড়াতে হলে অভ্যন্তরীণ বাজারকে শক্তিশালী করা অপরিহার্য।

সুতরাং, শুধু রিজার্ভ বৃদ্ধি বা বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা দেখে আত্মতুষ্টিতে ভোগার সুযোগ নেই। অর্থনীতির এই ‘সঠিক পথ’ যদি সাধারণ মানুষ ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক হয়, তবে সেই পথের পুনর্মূল্যায়ন জরুরি। নীতি নির্ধারকদের এখন একটি ভারসাম্যপূর্ণ কৌশল খুঁজে বের করতে হবে, যেখানে সামষ্টিক স্থিতিশীলতা অর্জনের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ শিল্পের সুরক্ষা এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির ওপর সমান গুরুত্ব দেওয়া হবে। সিএমএসএমই খাতকে টিকিয়ে রাখতে বিশেষ প্রণোদনা, জ্বালানি সংকটের স্থায়ী সমাধান এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর মতো পদক্ষেপ ছাড়া এই ‘সুস্থতার’ পরিসংখ্যানগুলো একটি ফাঁপা কাঠামো হিসেবেই দাঁড়িয়ে থাকবে, যার নিচে চাপা পড়বে লাখো মানুষের দীর্ঘশ্বাস আর হতাশার গল্প।

লেখক: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।