কেঁদে ওঠার শক্তিও নেই: গাজায় দুর্ভিক্ষের নীরব শিকার শিশুরা


গাজার ক্লিনিকগুলোতে এখন এক হৃদয়বিদারক নীরবতা। দিনের পর দিন অভুক্ত থাকতে থাকতে কঙ্কালসার হয়ে পড়া শিশুরা এতটাই দুর্বল যে, তাদের বেদনায় চিৎকার করে কেঁদে ওঠার শক্তিটুকুও অবশিষ্ট নেই। তাদের শরীরগুলো ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে আসছে, যেন এক জীবন্ত মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়েছে অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ড।

এই মর্মান্তিক দৃশ্যের কথাই বলছিলেন অলাভজনক প্রতিষ্ঠান সেভ দ্য চিলড্রেনের প্রেসিডেন্ট ইনগার অ্যাশিং। তিনি তুলে ধরেছেন এক নিষ্ঠুর বাস্তবতা—যখন খাদ্যের অভাবে একটি শিশুর দেহের সব চর্বি নিঃশেষ হয়ে যায়, তখন তার শরীর নিজেই নিজেকে খেতে শুরু করে। শক্তি জোগাতে পেশি ও অভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো ক্ষয় হতে থাকে। অ্যাশিং বলেন, “আমাদের ক্লিনিকগুলো প্রায় নীরব। শিশুরা কথা বলার বা কান্নার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। তারা নিস্তেজ হয়ে শুধু শুয়ে থাকে। কার্যত, তাদের দেহগুলো ক্ষয়ে যাচ্ছে।”

জাতিসংঘ গত সপ্তাহে গাজায় আনুষ্ঠানিকভাবে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করেছে, যা কোনো যান্ত্রিক শব্দ ছিল না। এটি ছিল শত শত শিশুর নীরব মৃত্যুর এক আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি। আল-জাজিরার তথ্য অনুযায়ী, শুধু শুক্রবারই অনাহারে ও অপুষ্টিতে আরও দুটি শিশুসহ পাঁচজনের প্রাণ গেছে। এ নিয়ে অনাহারে মৃত্যুর মিছিলে যোগ দিয়েছেন ৩২২ জন, যাদের মধ্যে ১২১ জনই শিশু। প্রতিটি সংখ্যা একটি পরিবারের স্বপ্নভঙ্গের গল্প, একটি অপূর্ণ জীবনের করুণ পরিণতি।

জাতিসংঘের ক্ষুধা নিরীক্ষক সংস্থা (আইপিসি) জানিয়েছে, গাজা গভর্নরেটের পাঁচ লাখ মানুষ এরই মধ্যে দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাসে পড়েছেন। তাদের পূর্বাভাস আরও ভয়ঙ্কর: আগামী মাসের শেষ নাগাদ উপত্যকার দুই-তৃতীয়াংশ অঞ্চলই এই দুর্ভিক্ষের কবলে পড়বে। আর এই মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষের জন্য ইসরায়েলের ‘নিয়মতান্ত্রিকভাবে ত্রাণ প্রবেশে বাধা দেওয়াকে’ দায়ী করা হয়েছে।

গাজার এই নীরব আর্তনাদ কাঁপিয়ে দিয়েছে বিশ্ববিবেক। সাধারণ মানুষ যেমন রাস্তায় নামছে, তেমনি বিভিন্ন দেশের সরকারও নড়েচড়ে বসছে। ব্রিটিশ সরকার লন্ডনে অনুষ্ঠিতব্য এক অস্ত্র প্রদর্শনীতে ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের নিষিদ্ধ করেছে, যা পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে ইসরায়েলের বাড়তে থাকা দূরত্বেরই ইঙ্গিত। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদেও যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া বাকি ১৩টি সদস্য রাষ্ট্র এই দুর্ভিক্ষে ‘গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ’ প্রকাশ করেছে।

কিন্তু একদিকে যখন বিশ্বজুড়ে ক্ষোভ বাড়ছে, ঠিক তখনই ক্ষুধার্ত মানুষের ওপর বোমার বর্ষণ চলছে। ইসরায়েল গাজা সিটিকে ‘ভয়ংকর যুদ্ধক্ষেত্র’ ঘোষণা করে নতুন করে হামলা শুরু করেছে। গত এক দিনে ত্রাণপ্রত্যাশী ২৩ জনসহ অন্তত ৫৯ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এ নিয়ে ইসরায়েলি আগ্রাসনে মোট নিহতের সংখ্যা ৬৩ হাজার ছাড়িয়েছে, যাদের মধ্যে একটা বড় অংশই নারী ও শিশু। যারা বোমা থেকে বাঁচছে, তারা মারা যাচ্ছে ক্ষুধায়। আর যারা ত্রাণের জন্য ছুটছে, তারাও পরিণত হচ্ছে নিথর দেহে।

রাজনৈতিক বিবৃতি, সামরিক অভিযান আর আন্তর্জাতিক উদ্বেগের ডামাডোলে হারিয়ে যাচ্ছে গাজার শিশুদের নীরব কান্না। যে কান্নার শব্দ নেই, কিন্তু যার বেদনা মহাবিশ্বের বাতাসকে ভারী করে তুলেছে।