
বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃদপিণ্ড বা প্রধান গেটওয়ে হলো চট্টগ্রাম বন্দর। দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ৯২ শতাংশই পরিচালিত হয় এই বন্দরের মাধ্যমে। তাই এর প্রতিটি নীতিগত সিদ্ধান্ত, প্রতিটি মাশুল পরিবর্তন দেশের শিল্প, বাণিজ্য এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। সম্প্রতি, এই বন্দরের বিভিন্ন সেবার ট্যারিফ বা মাশুল এক লাফে গড়ে ৪১ শতাংশ বৃদ্ধির যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তা সমগ্র ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এবং অর্থনীতিবিদদের মধ্যে একযোগে উদ্বেগ ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এই প্রস্তাব কেবল অপ্রত্যাশিতই নয়, এর পেছনের যুক্তি এবং সম্ভাব্য পরিণতি দেশের অর্থনীতির জন্য এক অশনিসংকেত বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রস্তাবনার গভীরে গেলে এক চমকপ্রদ তথ্য বেরিয়ে আসে। প্রধান অর্থ ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার বয়ান অনুযায়ী, এই মাশুল বৃদ্ধির মূল উদ্দেশ্য হলো মাতারবাড়ী চ্যানেল নির্মাণসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য গৃহীত ঋণের দায় পরিশোধ এবং বন্দরের ক্রমবর্ধমান অপারেশনাল ব্যয় নির্বাহ করা। এখানেই মৌলিক প্রশ্নটির জন্ম হয়—বন্দরের দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন ও সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে গৃহীত ঋণের বোঝা কি সরাসরি বর্তমান ব্যবহারকারী বা ব্যবসায়ীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যৌক্তিক? মাতারবাড়ীর মতো কৌশলগত প্রকল্পগুলো নিঃসন্দেহে দেশের ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগ। এ ধরনের জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর অর্থায়ন দীর্ঘমেয়াদী রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা, বন্দরের পুঞ্জীভূত মুনাফা অথবা আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের সহজ শর্তের ঋণের মাধ্যমে হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু তার দায়ভার মেটাতে তড়িঘড়ি করে সেবামাশুল ৪১ শতাংশের মতো বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি করা হলে তা কেবল অন্যায্যই নয়, বরং এক অদূরদর্শী আর্থিক ব্যবস্থাপনার পরিচায়ক। এটি উন্নয়নকে একটি বোঝা হিসেবে উপস্থাপন করে, যা সেবাগ্রহীতাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এই প্রস্তাবের অযৌক্তিকতা আরও প্রকট হয়ে ওঠে যখন আমরা চট্টগ্রাম বন্দরের আর্থিক অবস্থার দিকে তাকাই। এটি কোনো লোকসানি বা ধুঁকতে থাকা প্রতিষ্ঠান নয়। প্রদত্ত তথ্য অনুসারেই, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বন্দর কর্তৃপক্ষ ২,৩১৪ কোটি টাকা ব্যয়ের বিপরীতে আয় করেছে ৫,২২৭ কোটি টাকা, অর্থাৎ নীট মুনাফা দাঁড়িয়েছে ২,৯১৩ কোটি টাকা। একটি প্রতিষ্ঠান যখন হাজার হাজার কোটি টাকা মুনাফা করছে, তখন আর্থিক সংকট বা ঋণ পরিশোধের দোহাই দিয়ে সেবার মূল্য প্রায় অর্ধেক বাড়িয়ে দেওয়ার প্রস্তাবনাকে কোনোভাবেই স্বাভাবিক বলা চলে না। এই বিপুল মুনাফা প্রমাণ করে যে, বন্দরের হাতে তার পরিচালন ব্যয় নির্বাহ এবং ঋণের কিস্তি পরিশোধের জন্য যথেষ্ট সক্ষমতা রয়েছে। উপরন্তু, বন্দর কর্তৃপক্ষের অন্যতম প্রধান অঙ্গীকার হলো ‘ন্যূনতম খরচে এবং সবচেয়ে কম সময়ে সেবা প্রদান করা’। বর্তমান প্রস্তাবনাটি তাদের নিজেদের ঘোষিত এই নীতির সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। এটি চট্টগ্রাম বন্দরকে একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে একটি অতি মুনাফালোভী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার নামান্তর।
মাশুল বৃদ্ধির এই প্রস্তাবের প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী এবং বহুমাত্রিক। প্রথমত, এর সরাসরি আঘাত আসবে আমদানি খাতের ওপর। বাংলাদেশ একটি আমদানিনির্ভর দেশ। খাদ্যশস্য, সার, জ্বালানি তেল, ভোজ্যতেল থেকে শুরু করে শিল্পের কাঁচামাল পর্যন্ত সবকিছুই এই বন্দর দিয়ে আসে। মাশুল বাড়লে আমদানি খরচ বাড়বে। আমদানিকারকরা এই বর্ধিত খরচ পণ্যের মূল্যের সঙ্গে যুক্ত করে দেবেন, যার চূড়ান্ত বোঝা বহন করতে হবে সাধারণ ভোক্তাকে। দেশ যখন উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়াই করছে, তখন এই সিদ্ধান্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আরও বাড়িয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে দুর্বিষহ করে তুলবে।
দ্বিতীয়ত, এটি বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতার ওপর এক মারাত্মক আঘাত হানবে। তৈরি পোশাক, পাটজাত পণ্য, চামড়া বা হিমায়িত খাদ্যের মতো আমাদের প্রধান রপ্তানি পণ্যগুলোকে আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকতে হয় তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে। এখানে উৎপাদন ও পরিবহন খরচের সামান্যতম বৃদ্ধিও রপ্তানিকারকদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। বন্দরের মাশুল বাড়লে পণ্যের উৎপাদন থেকে শুরু করে জাহাজীকরণ পর্যন্ত সামগ্রিক খরচ বেড়ে যাবে। ফলে আমাদের পণ্য ভিয়েতনাম, ভারত বা কম্বোডিয়ার মতো প্রতিযোগী দেশগুলোর চেয়ে দামী হয়ে পড়বে। এর পরিণতিতে বিদেশি ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন, যা দেশের রপ্তানি আয় এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো এই প্রস্তাবনার সময়কাল। দেশের অর্থনীতি বর্তমানে এক ধরনের স্থবিরতা ও অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের নীতি হওয়া উচিত ব্যবসা-বাণিজ্যকে উৎসাহিত করা, বিনিয়োগের পরিবেশ সহজ করা এবং খরচের বোঝা কমানো। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরের এই প্রস্তাব ঠিক তার উল্টো পথে হাঁটছে। এটি অর্থনীতির ওপর ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দেওয়ার আশঙ্কা তৈরি করেছে। একদিকে ব্যবসায়ীরা টিকে থাকার লড়াই করছেন, অন্যদিকে তাদের ওপর এমন অস্বাভাবিক মাশুল চাপিয়ে দেওয়া হলে তা শিল্প ও বাণিজ্য খাতকে আরও সংকুচিত করে তুলবে।
অতএব, সকল দিক বিবেচনায় চট্টগ্রাম বন্দরের মাশুল বৃদ্ধির এই প্রস্তাব অযৌক্তিক, অন্যায্য এবং দেশের অর্থনীতির জন্য আত্মঘাতী। বন্দর কর্তৃপক্ষের উচিত মুনাফা নয়, সেবাকে প্রাধান্য দেওয়া। বন্দরের দক্ষতা বৃদ্ধি, আধুনিকায়ন, অহেতুক ব্যয় সংকোচন এবং দুর্নীতিরোধের মাধ্যমে আয় বৃদ্ধি ও খরচ কমানোর সুযোগ এখনও রয়েছে। উন্নয়নের দায়ভার ব্যবসায়ী বা ভোক্তার ওপর না চাপিয়ে, বরং নিজস্ব আয় এবং সঠিক আর্থিক পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব। আমরা দৃঢ়ভাবে আশা করি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ব্যবসায়ী নেতা ও অর্থনীতিবিদদের উদ্বেগ আমলে নিয়ে এই গণবিরোধী ও বাণিজ্যবিধ্বংসী প্রস্তাবনা থেকে সরে আসবে এবং দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।
